fbpx

মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা একই সঙ্গে একটি অধ্যয়নের বিষয় ও ব্যবস্থাপনা কৌশল যা একটি প্রতিষ্ঠানের অভীষ্ট লক্ষ্যসমূহ অর্জনের জন্য আভ্যন্তরীণ মানবসম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির ওপর আলোকপাত করে। কর্মীদের প্রতিষ্ঠানের প্রতি আকৃষ্ট করা, আগ্রহীদের মধ্য থেকে যোগ্যদের খুঁজে বের করা ও নিয়োগ প্রদান, কর্মীদের অনুপ্রাণিত করা ও তাদের সাথে প্রতিষ্ঠানের সু-সম্পর্ক বজায় রাখা, তাদের কর্মজীবনে উত্তরোত্তর উন্নয়নের পথ সৃষ্টি করা এবং প্রয়োজনে তাদের ছাঁটাই করাসহ প্রতিষ্ঠানের মানবসম্পদ সম্পর্কিত সব ধরনের কাজই প্রতিষ্ঠানের মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা বিভাগের কাজ। কিন্তু এর মূল উদ্দেশ্য হলো প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্যসমূহ অর্জন করা যার মধ্যে প্রধান চারটি হলোঃ

Thank you for reading this post, don't forget to subscribe!

ক) বিক্রয় ও রাজস্ব আয় বৃদ্ধি,

খ) মুনাফা অর্জন ও বর্ধন,

গ) মার্কেট শেয়ার বৃদ্ধি

ঘ) এবং প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি উন্নততর করণ

বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে সারা বিশ্বে শিল্প বিপ্লব শুরু হলে তুমুল প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মীদের দিয়ে অবৈধভাবে কাজ করিয়ে নেয়ার প্রবণতা বেড়ে যায়। এর ফলে শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দিতে থাকে। মূলত এই শ্রমিক অসন্তোষের ফলেই মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা ধারণার জন্ম হয়। তৎকালীন সময়ে মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনার কাজ ছিল শ্রমিকদের কর্ম-ঘণ্টার হিসাব রাখা এবং তাদের যথোপযুক্ত পারিশ্রমিক নিশ্চিত করা। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে প্রয়োজনের তাগিদে মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনার পরিধি অনেক বিস্তৃত হয়েছে। মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রথাগত পারসোনেল ম্যানেজমেণ্ট থেকে পৃথক।

বিংশ শতাব্দির সূচনা লগ্নের ন্যায় বতর্মানেও মানব সম্পদ বিভাগের দায়িত্ব পালনে প্রচুর প্রতিবন্ধকতা আমরা উপলব্ধি করছি। যে প্রতিবন্ধকতা গুলি উত্তরণের ফলে একটি উত্তম ও অগ্রসরমূখী কম পরিবেশ উপহার দেয়া সম্ভব।

কর্মী সংগ্রহ ও কোম্পানীর চাহিদানুযায়ী কর্মী সাপ্লাই ও সমন্বয় একটি মারাত্নক চ্যালেঞ্জ। যা থেকে উত্তরণের উপায় এই প্রতিযোগীতা র্পূণ বাবসায়িক বাজারে সম্পূর্ণ ভাবে সম্ভব নয়। কোম্পানী যতই সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা করুক না কেন কর্মীর সন্তুষ্টি অজন করা যেন সোনার হরিণ। তবে এ সংকট থেকে উত্তরণের জন্য অনেক কোম্পানী নিজস্ব সংকট দূরীকরণে স্ব স্ব ফ্যাক্টরীতে ট্রেইনিং সেন্টার চালু করে ফ্রেশারদের বিভিন্ন ক্রিটিক্যাল প্রসেসে প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছে। কিন্ত নিরাশার কথা হচ্ছে প্রশিক্ষন নেয়া শ্রমিকরা একটি নির্দিষ্ট সময় পার করার পরে তারা নিজেদের অভিজ্ঞ কর্মী মনে করে  চাকুরী ছেড়ে অন্যেত্র চলে যাচ্ছে। স্বল্প সময়ে ফ্রেশার কর্মীর সঠিক মুল্যায়ণ করতে অনেক সময় উর্দ্ধতনরা দ্বিমত পোষন করে থাকেন। তাদের এই ধরনের প্রবণতা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। নতুবা এসব কর্মীগণ অসহিষ্ণু হয়ে কোম্পানী ত্যাগ করে কোম্পানীকে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখিন করবে এবং এক কথায় এ পদ্ধতি কোম্পানীতে সাসটেইন করবে না।

আমাদের আরএমজি সেক্টরে আন অথোরাইজড এবসেন্ট  করে চলে যাওয়া শ্রমিকদের মাইগ্রেশনের এর একটি বৃহৎ অংশ দখল করে আছে। আন অথোরাইজড এবসেন্ট এর একটি ফাইল ক্লোজ করতে আমাদের প্রচলিত আইনে ৩০ দিনেরও অধিক সময় লাগে। অথচ একটি ছোট কারখানায় যদি এরকমের ১০ জন শ্রমিক আন অথোরাইজড এবসেন্ট থাকে তাহলে সে কোম্পানীতে কি নীতিতে কর্মী পরিকল্পনা করা যাবে তা বোধগম্য নয়। এজন্য একটি সূদুর প্রসারী পদক্ষেপ নেয়া আবশ্যক এবং প্রচলিত আইনে এর ব্যাখ্যা থাকা জরুরী।

আর এম জি সেক্টরে ম্যাক্সিমাম কোম্পানীর শ্রমিকগণকে তার দায়িত্ব নির্ধারণে কর্তৃপক্ষের গড়িমশি করতে দেখা যায়। প্রডাকশন নির্ভর কোম্পানীতে উৎপাদন জনিত জটিলতা দুর করতে অনেক সময় নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার আগেই কর্মীকে কাজের টার্গেট বুঝিয়ে দেয়া হচ্ছে। এমনকি কোন কোন কোম্পানী নতুন কর্মীর ২/৩ দিন কাজ করানোর পরেও তার বেতন নির্ধারণ করতে র্ব্যথ হচ্ছে। যা কর্মীর নেতিবাচক মনোভাব প্রসারিত করছে। এই প্রতিবন্ধকতায় শ্রমিক ফ্যাক্টরী ছেড়ে চলে গেলে এর দ্বায় কিন্তু আবার মানব সম্পদ বিভাগের এর উপর এসে পড়ে। এ প্রতিবন্ধকতা দুর করতে আমাদের মানব সম্পদ বিভাগের কর্মীদের মালিক পক্ষ ও প্রডাকশন বিভাগীয় প্রধানদের সাথে নিবিড় ভাবে আলোচনা হলেও  মানব সম্পদ বিভাগ এর কোন যুক্তিই প্রডাকশন জটিলতা বা জরুরী শিপমেন্ট এর কাছে পাত্তা পায় না।

এ প্রতিবন্ধকতায় কর্মীকে প্রাতিষ্ঠানিক সামাজিকীকরনের প্রক্রিয়াতেও মারাত্নক ক্ষতির সম্মুখিন হতে হয়। একজন নতুন শ্রমিককে নিয়োগ দানের পরে তাকে নিবিড় পর্যবেক্ষণ রাখতে হয়। পরিবেশের সাথে তাকে এডজাষ্ট করার জন্য মিনিমিাম সময় ও প্রশিক্ষণ প্রদান করা আবশ্যক। মনে রাখতে হবে প্রাথমিকভাবে আমরা কর্মী নিয়োগের সময় সামান্য কয়েক মিনিট তাদের সাথে মৌখিক ইন্টারভিউয়ের মাধ্যমে তাদের নির্বাচন করে থাকি। এত অল্প সময়ে একজন কর্মীর দক্ষতা যাচাই করা আদৌ সম্ভব নয়।  কিন্তু পরিতাপের বিষয় আমরা অধিকাংশ কোম্পানীতে নতুন শ্রমিকদের নিবিড় পর্যবেক্ষণ বা তাদের ফলো আপ করার সুযোগ পাই না। অথবা যথেষ্ট সুযোগ থাকলেও উৎপাদনজনীত কারনে ট্রেইনিং সিডিউল অনুযায়ী মানব সম্পদ বিভাগ কাজ করতে পারছে না।

কর্মীর দক্ষতা বা উন্নয়নেও কিছু বৈশাদৃশ্য দেখা যায়, নানাবিধ কারনে আমাদের শ্রমিকদের দক্ষতা উন্নয়নের সঠিক কোন ফর্মুলা প্রয়োগ করা হয় না। সাম্প্রতিক কালের বৈশ্বিক প্রতিযোগীতায় বায়ার সংকট ইদানিং আমাদের মধ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। ক্রেতাগণ প্রোডাক্টের যথাযথ মুল্য প্রদান না করায় অধিকাংশ সময় আমরা গদবাধা নিয়মে কর্মীর দক্ষতা মুল্যায়ন করে থাকি। এই প্রতিবন্ধকতায়ও কর্মী কমস্থল ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। ফলশ্রুতি স্বরুপ কোম্পানী দক্ষ কর্মী হারিয়ে আর্থিকভাবে ক্ষতির সম্মুখিন হয়।

প্রত্যেকটি কোম্পানীই চায় নিজের প্রতিষ্ঠানকে অন্য প্রতিষ্ঠান থেকে ব্যতিক্রমী পদ্ধতিতে  পরিচালনা করতে।  নির্দিষ্ট নীতিমালা থেকে নানা মুখি নীতিমালার প্রচলন করতে, হ্যা এটা একটি ভাল উদ্যোগ। তবে মনে রাখতে হবে স্থানীয় কৃষ্টি কালচারের সাথে এসব নীতিমালার সামঞ্জস্য থাকতে হবে নতুবা কর্মীর জন্য এটা একটি প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে। এ প্রতিবন্ধকতা দুর করতে বেশি বেশি সচেতনতামুলক কর্মশালা, সভা, সেমিনার বা প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা করা আবশ্যক।

আমরা কর্মী নিয়োগদানের পরেই তাকে টার্গেট এর জালে আবদ্ধ করি বা কর্মীকে যন্ত্রের ন্যায় ব্যবহার করে থাকি, যা আদৌ সঠিক উপায় হতে পারে না। কর্মীর কাছ থেকে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য পেতে হলে তাকে উৎসাহ প্রদান করা, তার জন্য বিনোদনের ব্যবস্থা রাখা সহ তার জন্য কল্যাণমুলক ব্যবস্থা রাখা অতীব জরুরী একটি বিষয়। শুধু মাত্র উপরস্থ কর্তাব্যক্তিদের উৎসাহমুলক আচরণের মাধ্যমেও কর্মীর কাছ থেকে সাফল্য আদায় করা সম্ভব। কিন্তু আসল পরিস্থিতি ভিন্ন, অনেক সময় আমরা কর্তাব্যক্তিরাও কর্মীর মতো যান্ত্রিক হয়ে পড়ি। কর্মীর সাথে কাজ আদায় নিয়ে সদা সর্বদা বাক বিতন্ডে জড়িয়ে পড়ি, তাকে ভাৎসনা করে থাকি । কর্মীর নিকট থেকে কাঙ্ক্ষিত ফল পেতে এধরণের আচরণ মারাত্নক একটি প্রতিবন্ধকতা। যা থেকে উত্তরণ না হওয়া অবধি মানবসম্পদ বিভাগ দ্বারা কর্মীবান্ধব পরিবেশ উপহার দেয়া সম্ভব নয়।

আরেকটি প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে কর্মী যে স্তরেরই হোক না কেন তাকে স্বাধীন মত প্রকাশ করতে বাধা প্রদান করা হয়ে থাকে। কর্মী যদি প্রচালিত আইনের আওতায় কোন প্রাপ্যতা নিয়ে মত প্রকাশ করতে চায় তবে তাকে স্বাধুবাদ জানানো উচিত। কিন্তু বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে আমরা কর্মীকে স্বাধুবাদ তো দুরে থাক তাকে বিভিন্নভাবে নাজেহাল করতে উদ্ধ্যত হয়ে পড়ি।    মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা বিভাগকে এই বিষয়টি নিয়ন্ত্রণে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়। আমাদের মনে রাখতে হবে কর্মী যাই দাবী করুক না কেন তাদের দাবীর সাথে শ্রম আইন সাংঘর্ষিক কি না? যদি সাংঘর্ষিক হয়ে থাকে তবে তা থেকে শ্রমিকদের সরিয়ে আনাতেই  মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনার ইতিবাচক সাফল্য। অধিকাংশ  ক্ষেত্রে আমরা এ সাফল্য অর্জন করতে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে থাকি। এক্ষেত্রে মানবসম্পদ বিভাগকে আরো বেশি দায়িত্বশীল হতে হয়। আর যদি দাবী সাংঘর্ষিক না হয়ে তবে তা মেনে নেয়া একটি প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব।

শ্রমিকগণকে তাদের কাজের সাথে সংশ্লিষ্ট সকল বিষয়ের ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিক সমুহের যথাযথ ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ্ করাই মানব সম্পদ বিভাগ এর অন্যতম কাজ। কারখানার কর্ম পরিবেশে কোন ঝুঁকি আছে কি না তা নিরুপন করা সাধারণ শ্রমিকদের পক্ষে সম্ভব নয়। একমাত্র অভিজ্ঞ মানব সম্পদ কর্মীরাই এ সমস্ত ঝুঁকি সর্ম্পকে  জানতে পারেন। যেমন, কত মাত্রার শব্দে একজন কর্মী কাজ করতে পারবে, নিরাপদ পানির প্যারামিটার গুলি সঠিক বা উপযুক্ত  আছে কি না, আলোর স্বল্পতা বা আধিক্য আছে কি না, একজন শ্রমিকের জন্য  সঠিক জায়গা বরাদ্দ আছে কি না, তাদের পয়ঃনিস্কাশন ব্যবস্থা ঠিক আছে কি না ইত্যাদি। এসব ব্যাপারে অনেকাংশে মানবসম্পদ বিভাগকে আপোষ করতে বাধ্য করা হয়, যা আদৌ ঠিক না। যার ফলে কারখানায় কম্পাউন্ড ইফেক্টের সৃস্টি হয়। আর এসব কম্পাউন্ড ইফেক্ট একটি কোম্পানীর জন্য মারাত্নক ক্ষতিকর, যা কর্মীদের সাস্থ্যকে ঝুঁকির সম্মুখিন করে। যে কোন কিছুর বিনিময়ে মানব সম্পদ ব্যবস্থপনাকে এসব মারাত্নক প্রতিবান্ধকতা দুর করে স্বাভাবিক কর্মপরিবেশ তৈরি করতে হয়।  যেক্ষেত্রে মালিকসহ সকল পক্ষের সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাব থাকা জরুরী।

সর্বোপরি আমাদের মনে রাখতে হবে বৈশ্বিক পোশাক রপ্তানীতে বাংলাদেশের হিস্যা এখন ৬ দশমিক ৪ শতাংশ আর ভিয়েতনামের ৬ দশমিক ২ শতাংশ। উৎপাদনশীলতা ও দক্ষতা বৃদ্ধি, উদ্ভাবন, কাজের পরিবেশ সৃষ্টি, শ্রমিক মালিকের সম্পর্ক উন্নয়ন শুধু এই শিল্পখাতের উন্নয়নের জন্যই  নয় বরং গোটা অর্থনীতির স্বার্থেই জরুরী। আর মাত্র ৫ বছর পর বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী। শুধু টিকে থাকা নয়, পোশাক শিল্পকে আরও কয়েক ধাপ উন্নত স্তরে নিয়ে শ্রমিক-মালিক-শুভাকাঙ্খী একত্রে সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপন করবে এটাই হোক প্রত্যাশা।

Writer: Aminul Haque, Manager, HR Admin & Compliance at Dk Global Fashion Wear Ltd.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

error: Content is protected !!