তৌহিদুল ইসলাম চঞ্চল: উন্নত দেশে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকর্মীদের দক্ষতা ও কর্মনৈপুণ্য যাচাইয়ে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা হয়। কোনো কাজ বা ব্যক্তির মূল্যায়নে ব্যবহারের এই সূচক হলো ‘কি পারফরম্যান্স ইনডিকেটর’ বা ‘কেপিআই’। শুধু তা-ই নয়, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার কোনো একটি প্রকল্প, পণ্য প্রভৃতির উপযোগিতা ও চাহিদা মূল্যায়নেও কেপিআই ব্যবহার করা হয়। কোনো কর্মীর কাজের মূল্যায়নে সাধারণত একটি ভিত্তি (বেসলাইন) ধরে একটি লক্ষ্য (টার্গেট) ঠিক করা হয়। আর লক্ষ্যমাত্রা পূরণ শতকরা ভাগের ভিত্তিতে করে নির্ণয় করা হয়Ñব্যক্তি (ক্ষেত্রবিশেষে প্রকল্প, পণ্য) কাজে কতটা সফল, কিংবা কতটা গ্রহণযোগ্য।
আমরা যদি কোনো প্রতিষ্ঠানের কথা বিবেচনা করি, সেখানে কর্মীর মূল্যায়নের ক্ষেত্রে কেপিআই নির্ধারণ করা হয় এবং সে অনুযায়ী একটি নির্দিষ্ট সময় পরপর কর্মীদের মূল্যায়ন করা হয়। এটি হতে পারে তিন মাস, ছয় মাস, এক বছর কিংবা প্রতিষ্ঠানের নির্ধারিত কোনো সময়সীমা।
হালে কেপিআই নিয়ে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও তোড়জোড় চলছে। এর মাত্রা দেখে মনে হয়, আসলেই ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ চাচ্ছে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাজের মূল্যায়ন, প্রণোদনা, স্বীকৃতি ও পুরস্কার তাদের কর্মনৈপুণ্যের ভিত্তিতেই হোক! আদৌ কি তা-ই। যদি তা-ই হয়, তবে পোশাকসহ অন্যান্য শিল্প খাতে কর্মীদের চাকরি ছেড়ে দেওয়ার হার এত বেশি কেন?
নানা মুনির নানা মত। একেকজন একেক ব্যাখ্যা বা কারণ দেখাতে পারবেন; কিন্তু বোধ করি মূল কারণটি হলো ‘উন্নতির সিঁড়ি’ যে উপকরণ দিয়ে তৈরি, তা একই প্রতিষ্ঠানে চাকরির বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্রমেই শিথিল বা নড়বড়ে হয়ে যায়। আর একটা সময় পর তা আস্তাকুঁড়ে জায়গা করে নেয়।
এখন যদি চিন্তা করি, এহেন দশা কেন হয়Ñতার উত্তর হিসেবে কিছু বিষয় উঠে আসবে। উদাহরণ দেওয়া যাক।
সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের নেওয়া কেপিআই-সংক্রান্ত সব উদ্যোগ, যেমনÑপ্রশিক্ষণ, কাজের বিবরণ এবং মূল্যায়ন ফরম, যা হতে পারে লোকদেখানো, যা শুধু কর্মীদের মধ্যে প্রচারের জন্য ও তাদের আকৃষ্ট করার জন্য। অনেকটা লোকদেখানো করপোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতার (সিএসআর) কার্যক্রমের মতো। শুধু সংবাদপত্রে খবর হয়ে আসার জন্য, ছবিটার জন্য। হতে পারে নিরীক্ষা (অডিট) কোনো একটি ফাইন্ডিংসকে ধাপাচাপা দেওয়ার জন্য, হতে পারে ক্রেতার (বায়ার) চাহিদা, হতে পারে উচ্চতর পর্যায় থেকে কোনো সুবিধা বাগিয়ে দেওয়ার জন্য একটি উপলক্ষ! যত যা-ই হোক, বছর শেষে ওই পাঁচ শতাংশ বেতন বৃদ্ধি!
আরেকটি কারণ হলো টেকসই ব্যবস্থাপনা না থাকা। অধিকাংশ কারখানায় প্রায়ই দেখা যায় কোনো একটি পদ্ধতি (সিস্টেম) চালু করলে তা ছয় মাস থেকে এক বছর যথানিয়মে পরিপালন করা হয়ে থাকে, আর বছর না পেরোতেই আবার আগের অবস্থায় ফিরে যায়! কোনো কিছুই টেকসই কিংবা স্থায়ী নয়। কারণ হিসেবে অনেকে বলে থাকেন শিল্প খাত হলো উৎপাদননির্ভর (প্রোডাকশন-বেসড)। তাই সেই প্রোডাকশনের ধারাবাহিকতাকে ধরে রাখতে অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষার প্রয়োজন হয়। অকাট্য যুক্তি। কিন্তু যাদের দিয়ে কাজ করানো হচ্ছে, তাদের মানসিক প্রশান্তি না থাকলে সঠিক দক্ষতা এবং গুণগত মান আশা করা ঠিক নয়। এটি নিশ্চয়ই বলে বোঝানোর বিষয় নয়। দিন শেষে সবার চাওয়া হলো ব্যক্তিগত উন্নয়নের সুযোগ, যা কাজ কিংবা আয়-সংক্রান্ত। আর সর্বোপরি পরিবারের ভবিষ্যৎ। কোনো কর্মজীবী তখনই মানসিক শান্তি নিয়ে কাজ করতে পারেন, যখন তার এই চাওয়া-পাওয়া পূরণ হয়। আর তা পূরণ করতে কার্যকর মূল্যায়ন প্রক্রিয়ার কোনো বিকল্প নেই, যা হবে বাস্তবসম্মত ও নিরপেক্ষ। ধরা যাক, কোনো অপারেটর তিনটি মেশিন ও ছয়টি প্রসেস পারে এবং ঘণ্টায় চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদন করতে পারে। আরেক অপারেটর দুটি মেশিন দুটি প্রসেস পারে। বছর শেষে উভয়ের বেতন বৃদ্ধি সমান হলে যে ভালো কর্মনৈপুণ্য দেখিয়েছে, তার নিরুৎসাহিত ও হতাশ হওয়ার শঙ্কা থাকে। কেউ বলতে পারেন, আমরা তেমন করি না, যে ভালো কাজ দেয় তার বেতন বেশি বাড়াই। ঠিক আছে। তাহলে প্রশ্ন কীসের ভিত্তিতে বেতন বাড়ানো হলো? যে কম পেল, সে যদি প্রশ্ন করে ‘কেন অন্যজনকে বেশি দিলেন’ সেক্ষেত্রে নিয়োগকর্তা বা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা কী দৃষ্টান্ত দেবেন! এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট নিয়োগকর্তা বা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার উত্তর হতে পারে আমরা মূল্যায়ন ফরম ব্যবহার করেছি এবং সঠিক মূল্যায়ন পদ্ধতির মাধ্যমে কাজটি করেছি। সাবাশ! এক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠবেÑআচরণে কত নম্বর দেওয়া হলো? বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ১০০-তে ২০-৩০ থাকে। আর সেই অপারেটরের মূল্যায়ন কে করে? নিশ্চয় প্রাথমিকভাবে সুপারভাইজার এ কাজটি করেন? এখন প্রশ্ন হলো, আচরণ কেমন তা নির্ধারণ করার জন্য পরিমাপের মানদণ্ড কী আছে? বেশিরভাগ ক্ষেত্রে উত্তর আসবে হ্যাঁ অবশ্যই আছে! এক্ষেত্রে দেখা হয়, মূল্যায়নের সময়সীমায় (নির্ধারিত সময়) ওই কর্মীর ব্যবহার কেমন ছিল! একজন মানুষকে যখন কোনো পরিমাপের মানদণ্ড ছাড়া ধারণার ওপর কোনো সিদ্ধান্ত নিতে বলবেন, সেক্ষেত্রে ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রেই সম্ভাবনা থাকে সে কোনভাবে প্রভাবিত হবে? মূলত এক্ষেত্রে ব্যক্তিগত সম্পর্কটা বেশি প্রাধান্য পায়।
এরপর আরেকটি বাধা হিসাবে বলা যায়, কর্মকর্তা শ্রেণির মাঝে পেশাদারিত্বের অভাব। অধিকাংশ কারখানায় দেখা যায়, বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে অন্তঃকোন্দল কোনো একটি প্রক্রিয়াকে সবচেয়ে বেশি বাধাগ্রস্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত করে। শুধু সমান পদের মানুষ নয়, এমনকি অনেক ক্ষেত্রে টপ ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে অনেক ব্যবস্থাপক পদের কর্মকর্তার মাঝেও এ ধরনের কোন্দল পরিলক্ষিত হয়। এক্ষেত্রে ভুক্তভোগী হয় সাধারণ শ্রমিক, কিংবা অপেক্ষাকৃত নিচু পদের কর্মকর্তারা। ধরুন আপনি আমেরিকান কোনো একটি সংস্থার পরিক্ষিত একটি মূল্যায়ন পদ্ধতির ক্ষেত্রে অনুমোদনপ্রাপ্ত কোনো পেশাজীবীর মাধ্যমে আপনার কারখানায় মূল্যায়ন কার্যক্রম চালু করেছেন। কিন্তু সেই কারখানার পিএম/এইচআর ম্যানেজারের সঙ্গে জনৈক পরিচালকের দ্বন্দ্ব স্পষ্ট। এখন পিএম যদি কোনো শ্রমিক কিংবা সুপারভাইজারের ইনক্রিমেন্ট দেয় এক হাজার টাকা, সেই পরিচালক সেক্ষেত্রে কী করবে? শুনুন, তিনি সেই এক হাজার টাকা ঘেচাং করে কেটে ২০০ টাকা বানিয়ে দেবে! আর ধরুন, মানবসম্পদ ব্যবস্থাপক (এইচআর ম্যানেজার) সঠিক মূল্যায়ন পদ্ধতি নিশ্চিত করে কোনো এক্সিকিউটিভের বেতন বাড়ালো ৫০০ টাকা, কিন্তু পরিচালকের টেবিলে গিয়ে তা হয়ে গেল তিন হাজার টাকা! উভয় দৃশ্যপটে আমরা কী উপলব্ধি করতে পারছেন? এক্ষেত্রে কি সঠিক মূল্যায়ন হলো বলা যায়? এর অর্থ হলো একটি ব্যবস্থা ব্যক্তিগত সম্পর্কের কারণে উপেক্ষিত হলো, তা-ই নয় কি? এটা কি পেশাদারিত্বের পরিচয়? এমনও দেখা যায়, কোনো কারখানায় নতুন কোনো ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা যোগদান করলে চলে যাওয়া কারও প্রতিষ্ঠা করা সব কর্মপদ্ধতি বাদ দিয়ে, তার নিজের মতো করে আবার নতুন করে শুরু করে! এটা কি পেশাদারিত্বের পরিচয়? বাদ দেওয়া সেই কর্মপদ্ধতিগুলোর মাঝে হতে পারে কল্যাণকর কিছু ছিল! অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমরা নিজেকে জাহির করতে গিয়ে অপেশাদারের মতো আচরণ করি।
সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জটি হলো মূল্যায়ন পদ্ধতি বাস্তবসম্মত না হওয়া, আর যাদের জন্য এ পদ্ধতি তাদের মধ্যে তা সম্পর্কে সচেতনতার অভাব। এছাড়া অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায়, যেই কেপিআইগুলো নির্ধারণ করা হয়, তা পরিমাপের জন্য যৌক্তিক বোধগম্য মানদণ্ড থাকে না। আর সেজন্যই কেপিআই থাকে, কিন্তু তা কার্যকর হয় না! অর্থাৎ আমরা যেই কেপিআই সেট করি না কেন, তা পরিমাপের জন্য নির্দিষ্ট মানদণ্ড থাকতে হবে, যেমন উপস্থিতি আপনার প্রতিষ্ঠানের কেপিআই হলে, সেক্ষেত্রে সেই কর্মীর উপস্থিতির রিপোর্ট, যদি নিয়মানুবর্তিতা হয় সেক্ষেত্রে তার ডিসিল্পিনারি রেকর্ড, অর্থাৎ কোনো সতর্কপত্র, কারণ দর্শানোর নোটিস ইত্যাদি। অর্থাৎ প্রত্যেক কেপিআই’র জন্য দেখা যায়, মাপা যায়, বোঝা যায় এমন মানদণ্ড থাকতে হবে।
এর পরের কাজটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ; তা হলো কর্মীদের মাঝে সে সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি, যার জন্য প্রশিক্ষণের কোনো বিকল্প নেই। প্রশিক্ষণের সফলতার ক্ষেত্রে একটি বিষয় বিবেচনা করা জরুরি, যেমন নদীতে মাছ ধরা শিখতে জেলের কাছে ট্রেনিং নেওয়া ভালো, ফিশারিজের অধ্যাপকের কাছে নয়। যারা নিয়মিত মাছ ধরবে তাদের কাজের ধরন ও প্রয়োজনীতা অনুযায়ী বাস্তবিক অর্থে সেই অধ্যাপকের জ্ঞান তাদের জন্য প্রযোজ্য নয়। যেহেতু আপনার কর্মীগোষ্ঠীর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ওপর প্রশিক্ষণ দেবেন সেক্ষেত্রে তাদের শ্রেণি অনুযায়ী প্রশিক্ষণের উপকরণ তৈরি এবং উপযুক্ত প্রশিক্ষক নির্বাচন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। লক্ষ রাখতে হবে, প্রশিক্ষণে অবশ্যই কর্মীরা যেন বোঝে যে আপনি তার কাছে কী চাচ্ছেন, কতটুকু করলে তা সন্তোষজনক হিসেবে বিবেচিত হবে (কোনো অবস্থাতেই ১০০ শতাংশ আশা করা বাস্তবসম্মত নয়) আর বিনিময়ে সে কী পাবে। শুধু তাই নয়, তাকে আশ্বস্ত করতে হবে তার লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে আপনি তাকে কীভাবে সহযোগিতা করবেন।
আমাদের মনে রাখতে হবে, আমাদের কেপিআই নির্ধারণের সময়ও সতর্ক থাকতে হবে, যেন তা বাস্তবসম্মত হয়, যার জন্য করছি তার সম্মতি থাকে এবং স্বচ্ছ ও বোধগম্য হয়।
মানবসম্পদ প্রশিক্ষক ও পরামর্শক