fbpx
mde

তৌহিদুল ইসলাম চঞ্চল

Thank you for reading this post, don't forget to subscribe!

বাবা, দাদা, মামা, ভাই, চাচার নাম আর এসব নামের ভিড়ে হারিয়ে যায় কত শত যুবকের নাম। যে জীবনে কিছু করতে চেয়েছিল, চেয়েছিল প্রতিষ্ঠা কিন্তু একটা সময়ে এসে বুঝতে পারে, পাওয়া না-পাওয়ার হিসাবের খাতায় না পাওয়ার পাল্লাটাই ভারী। একটি লক্ষ্যহীন জীবন নিয়ে অবিরাম ছুটে চলা, কজনার ভাগ্যে জোটে লক্ষ্য নির্ধারণ করার সৌভাগ্য? এখানে লক্ষ্য ক্ষণেই পাল্টায়। তাই বলে কি যুবকের মেধা ছিল না? ছিল কি শুধু শূন্যতা? ভুল কথা। ছিল অনেক কিছুই। ছিল বা আছে, একটা পরিবর্তন করা, একটা নতুন কিছু করার মতো ক্ষমতা ভেতরে ছিল, যা কখনও বেরিয়ে আসেনি হয়তো স্থান, কাল, পাত্র, সুযোগ বা ভাগ্য একযোগে সাড়া দেয়নি তাই।

এফএম রেডিওর মতো ছোটবেলা থেকে যে শিশুর আশপাশে রাতদিন অবিরাম শুধু দুটি পেশার নাম বেজে চলেছে, ‘হয় ডাক্তার নয় ইঞ্জিনিয়ার’। হতেই হবে। আর তাই ছেলেবেলায় তার প্রাথমিক লক্ষ্য থাকে ওই দুটোই। অবুঝ শিশু, সে কী করে বুঝবে লক্ষ্য কী জিনিস? স্কুলে মায়েদের দীর্ঘ লাইন, দীর্ঘ প্রতীক্ষা, সমালোচনার ঝড় সব বিলীন হয় একটি চাওয়ার মাঝে ‘হয় ডাক্তার নয় ইঞ্জিনিয়ার’। যেন এটি বায়ুমণ্ডলের অক্সিজেন, যেখানে সেখানে চাইলেই পাওয়া যায়, একদম ফ্রি। ক্লাসে ১০০ জন ছেলে, সবার মা-বাবাই চাইছেন আমার ছেলেটা প্রথম হবে। হায়! শেষমেশ তা হয় না। এ-ও কি সম্ভব সবার পক্ষে? কমবেশি, ওপর-নিচ তো থাকবেই। তো একজন মধ্যম শ্রেণীর ছাত্রের কথা ধরি, প্রাথমিক শিক্ষার গণ্ডি পেরিয়ে যখন উচ্চমাধ্যমিক স্তরে এলো, বাবা ও মায়ের সেই একই আশা ছেলে আমার ‘ডাক্তার কিংবা ইঞ্জিনিয়ার’ হবে। তাহলে বাকি পেশাগুলো এলো কীভাবে? একবারও ওই শিশুকে জিজ্ঞাসা করা হয় না, তুমি কী হতে চাও? কিছু মানুষ ব্যতিক্রম যে নেই তা নয়, তাই বলে সবাই কি ব্যতিক্রম? ঠিক লক্ষ্য নামক একটি পরগাছাকে নিয়ে ছেলে আমার এগিয়ে চলছে দুর্বার গতিতে। এরপর এসএসসি গেলো, এইচএসসি গেলো, তবুও লক্ষ্য নেই, এলো ভর্তি পরীক্ষা। প্রথম পরীক্ষা হলো বুয়েটে, তারপর মেডিক্যাল। সব আশা শেষ, ছেলে আমার অকৃতকার্য হয়েছে, সব আশায় জলাঞ্জলি। এর পরের পরীক্ষাগুলো ছেলে নিজের উদ্যোগে দিয়ে কোনো রকমে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কোনো এক কলেজে বিজ্ঞানের একটি বিষয়ে ভর্তির সুযোগ মিলল। ধরি রসায়ন। পরিবারে কারও মুখের দিকে তাকানো যায় না, নিজেকে কেমন অপরাধী মনে হয়। সবাই ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে, বুঝি চিড়িয়াখানার বেবুন! এত দিনে একটা লক্ষ্য হলো রসায়নবিদ হবো। নতুন কিছু গবেষণা, আবিষ্কার, ভিনদেশে চাকরি, বস্তা ভরা টাকা, গাড়ি, বাড়ি, ব্যাংক ব্যালান্স আর কত কিছু নিয়ে স্বপ্ন দেখা শুরু। জীবনের হিসাব-নিকাশের ফঁাঁকে ইতিমধ্যে অন্য পরিবারের বিপরীত লিঙ্গের একজন সব স্বপ্নের মধ্যমণি হয়ে বিরাজ করছে হৃদয়ের গহিনে। লক্ষ্য এখন একটাই, রসায়নবিদ। এক বছরের জটসহ পঁাঁচ বছর পেরিয়ে সম্মান শ্রেণী সম্মানের সঙ্গে পাস করে মাস্টার্সে পদার্পণ। তো জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন মধ্যম মানের একটি কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে বাছা আমার কতটা গবেষণার সুযোগ পেয়েছে, তা আর বলতে! ঠিক মাস্টার্স পরীক্ষা শুরুর আগ থেকে আরেক চিন্তা মনের কোণে ভিড় করে, পাস করলে করবো কী? কেন বাবা, রসায়নবিদ হবে। তা যে আর হলো না। গবেষণা করতে স্বদেশ কিংবা বিদেশ যাওয়ার জন্য পর্যাপ্ত জ্ঞান আমি যে অর্জন করতে পারিনি, আমার কী দোষ বলো? আমি তো মধ্যম শ্রেণীর ছাত্র। কোনো রকম মাস্টার্সটা দ্বিতীয় শ্রেণীতে পাস করে ছেলে পড়লো অথৈ সাগরে। এদিকে প্রেয়সীর দিক থেকেও চরম চাপÑ‘শুনছো আমার বাসা থেকে ছেলে দেখছে, বিয়েটা বুঝি হয়েই গেলো!’ নে বাবা, কত ঝড় সামলাবি আর। এখন আর কি করা, ঝড়ের বেগে চাকরির সন্ধান। ইতিমধ্যে সংবাদপত্রে বেকারের সংখ্যা দেখে নিজেকে দুর্ভাগাই মনে হচ্ছে। কোথায় গেলো লক্ষ্য, কোথায় কী? আর ভেবে কী হবে, কোনোমতে একটা চাকরি পেলেই হলো। ছেলে এলো ঢাকায়, যান্ত্রিক নগর, কোটি মানুষের বসবাস। নিয়োগকর্তাদের দ্বারে কাতারে কাতারে যুবক শুধু একটি চাকরির প্রত্যাশায়। সদ্য লক্ষ্যকে বিসর্জন দিয়ে সাধারণের কাতারে দাঁড়ানো এক বেদনাবিলাসী যুবক, একটি চাকরির প্রত্যাশায়। হেঁটে এসো পদ্ধতিতে বাছা এক ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানে মেডিক্যাল প্রতিনিধি হিসেবে কাজ পেলো। শাবাশ। সম্মানের চাকরি, হাতে ব্রিফকেস, গলায় টাই, একটা মোটরবাইক আর সাথি হলো টার্গেট। নাও বাবা, জীবনের লক্ষ্য তো ছিল না বা থাকলেও পূরণ করতে পারোনিÑএখন এই লক্ষ্য অর্জন করো, তবেই ছয় মাসে চাকরি হবে পাকাপোক্ত। এক মাস গেলো, ছেলের লক্ষ্য আর পূরণ হয় না। এর মাঝে অনেক রাত অবধি ফার্মেসিগুলোয় টইটই করে ঘোরা, আবার ডাক্তারের পেছনে ঘোরা, এরপর প্রথম মাস যেতে না যেতে শুরু হলো ঊর্ধ্বতনের কঠিন চাপ, সব মিলিয়ে নাজেহাল। এদিক-সেদিক অপমান-লাঞ্ছনা, শিক্ষিত মানুষের তো কথাতেই কাজ হয়ে যায়, বলপ্রয়োগের প্রয়োজন পড়ে না। তো বাছাধন এই চাপের ভয়ে গেলো পালিয়ে। এদিকে প্রেমিকার বিয়ে পাকা, নিজেকে বড় অসহায় মনে হচ্ছে ছেলেটার। প্রেমিকা নিজ রূপ ও গুণে পেয়ে গেলো সেই ডাক্তার/ইঞ্জিনিয়ার এক পাত্র। আহা ছেলেটা যদি হতে পারতো! প্রেমিকার বিচ্ছেদের বেদনায় বন্ধুদের সঙ্গে একটুআধটু নেশাজাতীয় দ্রব্য পেটে ঢুকতে শুরু করলো। তবে করুণাময়ের কৃপায় তিন-চার বছরে স্বাভাবিক হতে শুরু করলো ছেলেটি। এখন বয়স সাতাশ। যাক সাতাশি নয়, তবুও সান্ত¡না। অনেকের এ যাত্রায় যবনিকা আসে না। এখন কী করবে, যে কিনা পরিবারের মধ্যমণি ছিলÑআজ সে সবার কাছে নিগৃহীত শুধু একটা চাকরি নেই বলে। বাড়ির কাজের লোকটাও বুঝে গেছে বেটার কাজ না করলেও চলবে, আবার মাঝে মাঝে সেই কাজের লোকের পক্ষ থেকেও উৎকোচস্বরূপ দু-একটা তির্যক কথা শোনা। মধ্যবিত্ত পরিবারে এই তো স্বাভাবিক, বাবার চাকরির মেয়াদ তো শেষ হলো বলে। অবশেষে একটা গতি হলো, যখন ছেলেবেলার এক বন্ধুর মাধ্যমে একটি প্রতিষ্ঠানের আইটি বিভাগে শিক্ষানবিশ হিসেবে যোগদান করলো। রসায়নে পড়ে আইটি বিভাগ। উন্নয়নশীল দেশে এটাই তো স্বাভাবিক।

ছেলের সামনে এখন লক্ষ্য একটাই কাজ শেখা আর কাজ করা। মন্দ নয়, কী বলেন? একটা লক্ষ্য তো হলো অবশেষে। কিন্তু বড্ড দেরি হলো বোধহয়। মোটামুটি একটা অবস্থানে আসতে আসতেও তাও কম করে হলে চার-পাঁচ বছর তো লাগবে। জীবনটা বেশ পিছিয়ে পড়লো। এরপর দেরিতে বিয়ে, তারপর ছেলেপুলে। আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই, যখন এ যুবকই একদিন চাইবে তার সন্তান ‘ডাক্তার কিংবা ইঞ্জিনিয়ার’ হবে! বংশপরম্পরায় লক্ষ্য একটাই। চাইলেই পাওয়া যায় বুঝি। সমাজে বুদ্ধিবৃত্তিকে জীবিকা হিসেবে নিয়ে কত মানুষ আজ প্রতিষ্ঠিত। ভিন্ন ভিন্ন নামের সে পেশাগুলো কেউ শিক্ষক, কেউ উকিল, কেউ সাংবাদিক, আরও কত কী। তারা কি প্রতিষ্ঠা পাননি? তো সমস্যাটা কোথায়? মূল সমস্যা হলো আমাদের মজ্জায় ঢুকে গেছে এ দুটি পেশার নাম। আরে ভাই, এ দুটিতে টিকতে গেলে উচ্চস্তরের মেধার প্রয়োজন হয়। আবার অনেক সময় মেধা থাকলেও নেহাত ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে অনেকে অকৃতকার্য হয়। সেক্ষেত্রে যারা এসএসসি থেকেই বাণিজ্যিক শাস্ত্র কিংবা মানবিক বিভাগে পড়ে, তারা কিন্তু এক ধাপ এগিয়ে থাকে। তারাও মেধাবী। এদের ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্নটা মুকুলেই ঝরে যায়। তাই জীবনটাকে ভিন্ন আঙ্গিকে দেখার একটা বিস্তৃত জায়গা পায়।

এত কিছু লেখার পেছনে উদ্দেশ্য একটাই, যদি ছোটবেলা থেকেই বাবা-মা শিশুদের লক্ষ্য নির্ধারণে সহযোগিতা করে, যা বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে হয়ে আসছেÑতবে শিশুটি ছোটবেলা থেকে যে হীনম্মন্যতায় ভুগত, অন্তত সেই অভিশাপ থেকে মুক্তি পাবে। কোমলমতি শিশুর মন এ ধরনের পরিস্থিতিতে তাকে দুর্বলচিত্তের করে গড়ে তোলে। শুধু লক্ষ্য নয়, কোনো কিছুই শিশুকে জোরপূর্বক চাপিয়ে দেওয়া ঠিক নয়। এখন আসি কীভাবে বাবা-মা শিশুর লক্ষ্য নির্ধারণে সহযোগিতা করবে? ফেসবুকে কিছুদিন আগে একটা ছবি ভাইরাল হলো, যেখানে মহান একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে ব্যানার কিংবা ফেস্টুনে অনেকে ৩০ লাখ শহীদের কথা লিখেছেন, কেউ আবার আমাদের গর্ব সাত বীরশ্রেষ্ঠের ছবি দিয়েছেন। আমার মতে, এতে সমস্যা নেইÑযদি ভাষা দিবসের সঠিক তাৎপর্য বা সংজ্ঞাটা কোনোভাবে বিকৃত না হয়। মানে সালাম-বরকতদের সঙ্গে সব শহীদকে স্মরণ করলাম। কিন্তু যদি এমনটা লিখি যে ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে আমরা মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকার আদায় করেছি আর শোক দিবসের রাত্রিতে দিব্বি দ্রুত লয়ের গানের সঙ্গে তাথৈ তাথৈ নাচি, তবে এ জনম বৃথা। আমি প্রায়ই পাড়া-মহল্লায় হিন্দি গান কিংবা দ্রুত লয়ের গান শুনেছি। ব্যানারের ব্যাপারটা কতটা সত্যি জানি না। তা হয়ে থাকলে নিশ্চয় আমাদের অন্ধত্ব, জ্ঞানের অপ্রতুলতা প্রমাণ করে। মূল কথায় আসি, আমরা যদি শিক্ষাব্যবস্থার একটি নির্দিষ্ট স্তরে এ বিষয়ে শিক্ষা দিই যে, কীভাবে লক্ষ্য নির্ধারণে অভিভাবকরা শিশুদের সহযোগিতা করবে, তাও ফলপ্রসূ হতে পারে। আর এর কার্যক্রমগুলো পারে তাদের প্রথমে বিভিন্ন বিষয়ে ধারণা দিতে, ছোট ধারণাগুলোকে ভাবতে সহযোগিতা করতে, ধারণাগুলো থেকে তাদের বাছাইয়ের সুযোগ দিতে, তাদের অভিব্যক্তি যেমন : যদি তারা কোনো পুরস্কার জেতার ইচ্ছা পোষণ করে, সে বিষয়ে তাদের উৎসাহ দেওয়া, সময় নিয়ে বাস্তব পরিস্থিতির বিষয়ে তাদের জানানো, তাদের সম্ভাব্য সম্ভাবনার কথা জানানো, তারা কিসে ভালো করছে তা লক্ষ রাখা, তারা কিছু করতে চাইলে প্রথমেই বাধা না দেওয়া বা নেতিবাচক কিছু না বলা। আরও বিভিন্নভাবে শিশুকে উৎসাহিত করা যায়। আমরা সবাই জানি, লক্ষ্যহীন জীবন সত্যি পীড়াদায়ক আর লক্ষ্যই যখন থাকে লক্ষ্যহীনতায়, জীবন বেড়ে ওঠে বিষন্নতায়!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

error: Content is protected !!