এ.টি.এম মোসলেহ্ উদ্দিন (জাবেদ)
Thank you for reading this post, don't forget to subscribe!ভূমিকম্প একটি প্রাকৃতিক দূর্যোগ। “ভূ” মানে পৃথিবী আর “কম্পন” মানে কাঁপা। সহজ কথায় ভূমিকম্প হলো পৃথিবীর কেঁপে উঠা। তার মানে পৃথিবী যখন কাঁপে তখন আমরা তাকে ভূমিকম্প বলি। পৃথিবীতে প্রতি বছর গড়ে প্রায় ছয় হাজার ভূমিকম্প হয়। তবে এগুলোর অধিকাংশই মৃদু যেগুলো আমরা টের পাই না। সাধারনত তিন ধরনের ভূমিকম্প হয়ে থাকে- প্রচন্ড, মাঝারি ও মৃদু। আবার উৎসের গভীরতা অনুসারে তিন ভাগে ভাগ করা যায়- অগভীর, মধ্যবর্তী ও গভীর ভূমিকম্প। ভূমিকম্পের কেন্দ্র ভূপৃষ্ঠের ৭০ কিলোমিটারের মধ্যে হলে অগভীর, ৭০ থেকে ৩০০ কিলোমিটারের মধ্যে হলে মধ্যবর্তী এবং ৩০০ কিলোমিটারের নিচে হলে গভীর ভূমিকম্প বলে।
সাধারনত তিনটি প্রধান কারনে ভূমিকম্পের উৎপত্তি হয়ে থাকে। প্রথমত: ভূপৃষ্ঠজনিত, দ্বিতীয়ত: আগ্নেয়গিরিজনিত ও তৃতীয়ত: শিলাচ্যুতিজনিত। ভূমিকম্পের মাত্রা মাপা হয় রিখটার স্কেলে। রিখটার স্কেলে এককের সীমা ১ থেকে ১০ পর্যন্ত। রিখটার স্কেলে মাত্রা ৫ এর বেশি হওয়া মানে ভয়াবহ দূর্যোগের আশঙ্কা। মনে রাখতে হবে, ভূমিকম্প এক ডিগ্রি বৃদ্ধি পেলেই এর মাত্রা ১০ থেকে ৩২ গুন বৃদ্ধি পেতে পারে। রিখটার স্কেলে ভূমিকম্পের মাত্রা ৫-৫.৯৯ মাঝারি, ৬-৬.৯৯ তীব্র, ৭-৭.৯৯ ভয়াবহ, ৮-এর উপরে অত্যন্ত ভয়াবহ।
সাম্প্রতিক সময়ে ভূমিকম্প নিয়ে জনমনে ব্যাপক আতঙ্ক তৈরী হয়েছে। কারন এটি এমন একটি প্রাকৃতিক দূর্যোগ, যার পূর্বাভাস দেয়ার উপায় এখনো বিজ্ঞানীরা বের করতে পারেনি। আমাদের দেশের প্রধান প্রধান শহরগুলোতে মানুষ বাড়ার পাশাপাশি আবাসিক-অনাবাসিক স্থাপনা বাড়ছে পাল্লা দিয়ে। কিন্তু সেইসব স্থাপনা কতটা মান সম্পন্ন, বড় ধরনের ভূমিকম্পে সেগুলো টিকে থাকবে কি না এই আশঙ্কা প্রবল। ভূমিকম্পের মতো দূর্যোগে নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে প্রয়োজনীয় খোলা জায়গাও নেই আমাদের বড় শহরগুলোতে। অভিযোগ রয়েছে, দেশে ভবন নির্মানে বিল্ডিং কোড মানা হয় না। ফলে মাঝারি ধরনের ভূমিকম্পও মারাত্নক বিপর্যয়ের কারন হয়ে উঠতে পারে। আর বড় ধরনের ভূমিকম্প ডেকে আনতে পারে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়। তাই ভূমিকম্পের বিপর্যয় থেকে রক্ষা পেতে সব ধরনের স্থাপনা এ দূর্যোগ মোকাবেলার উপযোগী করে গড়ে তুলতে হবে।
ভূমিকম্পকে বলা হয়- একই সঙ্গে জীবন, সম্পদ, নগর ও সভ্যতা বিনাশী। বলা হচ্ছে, বাংলাদেশ ভূমিকম্পের চরম ঝুঁকিতে রয়েছে। বাংলাদেশ দূর্ভাগ্যবশত ভারতীয়, ইউরেশীয় এবং মিয়ানমার টেকটনিক প্লেটের মাঝে আবদ্ধ। টেকটনিক প্লেটের অবস্থান দেখলে বোঝা যায় যে, আমাদের উত্তর-পূর্বে দুটো বর্ডার বা টেকনিক্যাল ভাষায় ‘ভূ-চ্যুতি’ রয়েছে, যা বাংলাদেশের ভূমিকম্পের কারণ। এজন্য উত্তরপূর্বাঞ্চল তথা বৃহত্তর সিলেট ও তৎসংলগ্ন এলাকা প্রবল ভূমিকম্প প্রবণ। এর পরের অংশগুলোও যেমন- ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম অঞ্চল ও ভূমিকম্প প্রবণ। এ অবস্থায় ভূমিকম্পের পর উদ্ধার প্রক্রিয়া ও প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি যতটুকু থাকা দরকার, তার প্রায় কিছুই নেই বললেই চলে। উদ্ধার কাজ পরিচালনার জন্য প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত জনশক্তির যেমন অভাব রয়েছে, তেমনি প্রযুক্তিগত দিক থেকেও পিছিয়ে আছি আমরা। এসব দিকে যথাযথ কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি দেয়া অধিক জরুরী।
সাম্প্রতিক সময়ে গত ৩রা জানুয়ারী বিকাল আনুমানিক ৩টা ১০ মিনিটের সময় আবারো ভূমিকম্পে প্রকম্পিত হয়েছিল সারা দেশ। রিখটার স্কেলে ৫.৫ মাত্রার এই ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ভারতের পূর্বাঞ্চলে, ভূপৃষ্ঠের ৩৬ কিলোমিটার গভীরে। এটির রেশ কাটতে না কাটতেই প্রায় দশ ঘন্টা পর ৪ঠা জানুয়ারী গভীর রাত আনুমানিক ১২টা ৫০মিনিটে আবারও ভূকম্পন অনূভুত হয়। এর উৎপত্তিস্থল আরেক পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়ানমার। এই ভূমিকম্পটির ফলে কম্পনের পাশাপাশি দেশের একটি অংশে ভূমিতে ফাটল ধরেছে এবং ঐ ফাটল দিয়ে ভূঅভ্যন্তরের বালি ও পানি বেরিয়ে আসতে দেখা গেছে। আতঙ্কে দুজনের মৃত্যু হয়েছে। এর ফলে সমগ্র দেশজুড়ে মানুষের মনে শঙ্কার সৃষ্টি হয়েছে। এবারের ভূমিকম্পে দেশের বড় ধরনের কোন ক্ষয়ক্ষতি না হলেও এটি একটি সতর্ক বার্তা দিয়ে গেছে। মাটি ফেটে বালি ও পানি বের হয়ে যাওয়ার বিষয়টিকে মোটেও হালকাভাবে দেখার সুযোগ নেই।
বিশ্বে সবচেয়ে ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকার একটি হলো চিলি। সেখানে ১৯৬০ সালে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী (রিখটার স্কেলে ৯.৫ মাত্রা) ভূমিকম্প হয়। তাই চিলি ধীরে ধীরে তাদের সব বিল্ডিং ভূমিকম্প সহনীয় করে গড়ে তুলেছে। সে কারনে বড় ভূমিকম্পতেও সেখানে ক্ষয়ক্ষতি খুব কম হয়। সম্প্রতি ২০১৫ সালে চিলিতে ৮ মাত্রার বেশি ভূমিকম্প আঘাত হেনেছিল। যাতে মানুষ মারা যায় মাত্র তেরজন। অথচ হাইতিতে ২০১০ সালে ৭ মাত্রার ভূমিকম্পে প্রায় তিন লাখ মানুষ মারা যায়। এর প্রধান কারণ দূর্বল স্থাপনা। হাইতিতে বলতে গেলে ভূমিকম্প সহনীয় বিল্ডিং নেই, তাই ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা হয় ব্যাপক।
এ প্রেক্ষিতে বিশ্বের অন্যতম ভূমিকম্প প্রবণ দেশ জাপানের কিছু পদক্ষেপ তুলে ধরা হল। ২০১১ সালের ১১ মার্চে সেদেশের তহুকু রিজিওনে প্রায় ৯ মাত্রার যে ভূমিকম্প হয় তাতে রাজধানী টোকিও শহরেও ঝাঁকুনি লেগেছিল প্রায় ৭ মাত্রায়। কিন্তু এতেও রাজধানী বহুতল অট্টালিকাগুলো ধসে যাওয়ার বা মানুষ নিহত হবার ঘটনা ঘটে নাই। নির্মাণ শিল্পে ভূমিকম্প প্রতিরোধী প্রযুক্তি রক্ষাকবচ হিসেবে একটা পর্যায় পর্যন্ত পুরোপুরি কার্যকরী, এমনকি বিরল শক্তিমাত্রার কম্পনেও (৯ মাত্রার) ক্ষয়ক্ষতি কমাতে দারুণ ভূমিকা রাখে।
ভূমিকম্প প্রস্তুতিতে বিশ্বের নেতৃস্থানীয় দেশ জাপান। ২০১১ সালের তহুকু ভূমিকম্পটি ছিল জাপানের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় মাত্রার আর বিশ্বে পঞ্চম। অতি দ্রুত ধেয়ে আসা সুনামি ছিল ধ্বংসযজ্ঞের মূল কারণ। যা সমস্ত প্রস্তুতি কার্যক্রমকে অকার্যকর করে দিয়েছিল। এটা যদি ঘন্টা খানেক সময় দিত, নিহতের সংখ্যা ব্যাপকভাবে কমে যেত। ফুকুশিমা নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্টের দূর্ঘটনা সমস্যাটিকে আরো জটিল করে তুলেছিল।
২০১৫ সালে নেপালের ভূমিকম্প আর মনিপুরের সাম্প্রতিক ভূমিকম্পের পর বাস্তবতা হচ্ছে, এই বিপর্যয়ের আশঙ্কার মধ্যেই বাংলাদেশীদেরও বসবাস করতে হবে। এখানে শহরাঞ্চলে মূল ক্ষয়ক্ষতি হবে স্থাপনা ধসে। মর্মান্তিক এক পরিণতির আশঙ্কায় ভীতির সঙ্গে বসবাসের চেয়ে কঠিন সময় কঠিনতম দৃঢ়তায় মোকাবেলা করার প্রত্যয় নিয়ে প্রস্তত থাকতে হবে।
বাংলাদেশের স্থাপনাসমূহ নিয়েও এরকম শঙ্কা রয়েছে। তাই ক্ষয়ক্ষতি যাতে কম হয় সেজন্য সরকার প্রণীত বিল্ডিং কোড মেনে ভবন নির্মান করা হলে বড় ধরনের বিপর্যয় এড়ানো সম্ভব হবে। এছাড়া বিপদ মোকাবেলায় সাধারন মানুষকে মানসিকভাবে প্রস্তুত রাখা এবং নিয়মিত মহড়া ও স্বেচ্ছাসেবক তৈরীর উপরও গুরুত্ব দিতে হবে।
ভূমিকম্পের সময়ে যা করবেন–
- ভূমিকম্প হচ্ছে বুঝতে পারলে জীবন বাঁচাতে হলে প্রথমে মাথা ঠান্ডা রাখার চেষ্টা করতে হবে। কোন ভাবেই আতঙ্কিত হওয়া যাবে না।
- যদি বাসাবাড়িতে থাকেন তাহলে মাথা বালিশ দিয়ে ঢেকে টেবিল, খাট বা শক্ত কোন আসবাবপত্রের নিচে আশ্রয় নিন।
- মনে রাখবেন, ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতির অন্যতম কারণ গ্যাস ও বিদ্যুৎ থেকে লাগা আগুন। তাই দ্রুততার সহিত রান্নঘরের গ্যাসের চুলা, ঘরের বৈদ্যুতিক সুইচগুলো বন্ধ করতে হবে।
- ভূমিকম্পের সময় খালি পায়ে নয়, শক্ত জুতা পরে চলফেরা করুন যাতে গ্লাস, মেটাল ইত্যাদির ইনজুরি থেকে রক্ষা পেতে পারেন।
- ব্যাটারী চালিত রেডিও, টর্চলাইট বা ম্যাচ-মোমবাতি, পানি, শুকনো খাবার ও প্রাথমিক চিকিৎসার সরঞ্জাম সব সময় ঘরে রাখা প্রয়োজন।
- গ্যাস লিকেজ আছে কি না তা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত ম্যাচ-মোমবাতি জ্বালাবেন না।
- হুইল চেয়ারে থাকলে, চাকা লক বা বন্ধ করে হাত দিয়ে মাথা ও ঘাড় ঢেকে রাখুন।
- স্কুল, কলেজ বা অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে থাকলে ছাত্রছাত্রীরা স্কুলব্যাগ মাথায় দিয়ে শক্ত টেবিলের নিচে অশ্রয় নিতে হবে।
- ভূমিকম্পের সময় বহুতল ভবন থেকে নামতে হলে সিঁড়ি ব্যবহার করতে হবে। কোনক্রমেই লিফট ব্যবহার করবেন না। লিফটে থাকলে নিকটবর্তী ফ্লোরে তাড়াতাড়ি নেমে পড়ুন।
- বেশি উপরতলায় থাকলে কম্পন বা ঝাঁকুনি না থামা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে, কম্পন বা ঝাঁকুনি থামলে দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে খোলা জায়গায় বা নিরাপদ স্থানে অবস্থান নিন। তাড়াহুড়ো করে লাফ দিয়ে নামা যাবে না।
- শিল্প-কারখানা, হাসপাতাল, মার্কেট, সিনেমা হলে থাকলে হুড়োহুড়ি করে বের হওয়ার জন্য দরজার সামনে ভিড় বা ধাক্কধাক্কি করতে যাবেন না। যেখানে আছেন সেখানেই দুহাতে মাথা ঢেকে বসে থাকুন।
- গাড়িতে থাকলে রাস্তা ব্লক না করে একপাশে থেমে যান এবং ভিতরে থাকুন। ব্রিজ, ওভারব্রিজ, ফ্লাইওভার, আন্ডারপাস, গাছ, বৈদ্যুতিক খুঁটি, বিলবোর্ড ইত্যাদি থেকে দূরে থাকতে হবে। পিছন থেকে ছুটে আসা গাড়ি থেকে সতর্ক থাকুন, রিয়ার মিররের উপর নজর রাখতে হবে।
- ঘরের বাইরে যেখানেই থাকুন না কেন বড় গাছ, উঁচু বাড়ি, বৈদ্যুতিক খুঁটি ইত্যাদি থেকে দূরে খোলা স্থানে আশ্রয় নিতে হবে।
- সমূদ্র বা নদীর ধারে থাকলে যথাশীঘ্র দ্রুততার সঙ্গে উঁচু জায়গায় অবস্থান নিতে হবে।
- একবার কম্পন হওয়ার পর আবারও কম্পন হতে পারে। তাই সুযোগ বুঝে বিল্ডিং থেকে বের হয়ে খালি জায়গায় চলে যাওয়ার চেষ্টা করুন।
মানুষ মানুষের জন্য। বিপদের সময় আপনার মনুষ্যত্ব যেন আপন মহিমায় আলো ছড়ায়। নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে প্রতিবেশীদের প্রতিও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। বিপদ থেকে রক্ষার পাশাপাশি বিপদে ভয় না পেয়ে সাহসের সঙ্গে মোকাবিলা করার চেষ্টা করতে হবে। বড় ধরনের ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতি কতটা নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে তা বলা মুশকিল, তবে প্রস্তুতি থাকলে মোকাবিলা করতে সুবিধা হবে। জাতীয় পর্যায়ে লজিস্টিক্যালি ক্ষয়ক্ষতি নিয়ন্ত্রনে আমাদের সক্ষমতা হয়তো খুবই অপ্রতুল। কিন্তু ব্যক্তিগত বা দলবদ্ধভাবে উপরের গাইড লাইনগুলো মেনে চললে প্রাণহানি বা আহত হবার ঘটনা অনেকখানি নিয়ন্ত্রন করা যাবে।
লেখকঃ HR & Admin Professional at A Leading Group of Company