
মাকছুদার রহমান
হ্যালো মা, গাড়ী ছাড়ছে, কখন আসি পৌছামেন বাবা (কতক্ষন লাগবে আসতে)? ঘাটাত (রাস্তাত) অনেক জ্যাম কতক্ষন যে নাগে (লাগে)! আচ্ছা বাবা দেকি শুনি আস (ভাল ভাবে আস)।
দীর্ঘ অপেক্ষার পর হারুন মিয়া বাসে উঠেই মা এর সাথে তার উপরোক্ত ফোনালাপ। ঈদে হারুন বাড়ী আসছে সাথে করে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে অনেক স্বপ্ন। মা চেয়ে আছে ছেলের পথ পানে। কিছুদিন আগে হারুন বিকাশে কিছু টাকা পাঠিয়েছে তাই দিয়ে মা সেমাই, চিনি কিনে রেখেছে, হারুন আসলেই রান্না করে সবাই মিলে খাবে।
হারুনের বাবা নাই, মা আর একটা ছোট ভাই ও একটা ছোট বোন মোট চারজনের সংসার। হারুন মিয়ার বয়স খুব বেশী হলে আঠারো। তারপর বোন বয়স পনের বিয়ের কথা মোটামুটি পাকা, আগামী কোরবানির ঈদেই হবে। হাজার বিশেক টাকা খরচ করতে হবে হারুনকে, আর মা কিছু জমিয়েছে তাই দিয়ে বোনের বিয়ে দেবে।
বেতন আর ওভার টাইম সব মিলে হারুন প্রায় আট হাজার টাকা পায়, প্রতি মাসে ঘর ভাড়া, খাওয়া আর হাত খরচ শেষে দুই বছরে সে হাজার ত্রিশ টাকা জমাতে পেরেছে।
এবছর ঈদের বেতন, বোনাস দিয়ে সবার জন্য কিছু কেনাকাটা করেছে, আর জমানো টাকাটা খুব গোপন জায়গাতে নিয়ে বাড়ীর উদ্দেশ্য রওনা হয়েছে।
গাজীপুর চন্দ্রায় গাড়ী থেমে থাকে ঘন্টার পর ঘন্টা। আশেপাশে শত শত গাড়ী, বেশির ভাগই লক্কর ঝক্কর মুড়ির টিন যার সবগুলোতেই তার মত পোশাক শ্রমিক, গাড়ীর ভিতরে যত, ছাদে তার চেয়েও বেশী যাত্রিতে বোঝাই।
রাত পোহালেই কাল ঈদ, বিকালে গার্মেন্টস ছুটি হওয়াতে সবারই একসাথে গ্রামের বাড়ী যাবার তাড়া। যাত্রীর অতিরিক্ত চাপের কারনে ঢাকা শহরে চলাচলকারী গাড়ীগুলো মাত্রাতিরিক্ত ভাড়ায় এইসব দূরপাল্লার যাত্রী পরিবহন করে বছরের পর বছর। এগুলোর কোন ধরনের ফিটনেস পরীক্ষা কখনই হয়না। কর্তাব্যক্তিরা ফি বছর হুংকার দেন বটে, বাস্তবে তার কোন প্রতিফলন দেখা যায়না।
শ্রমিক সংগঠনগুলো বেতন, বোনাসের জন্য আন্দোলন করে, কোন কারখানায় একজন শ্রমিককে আঘাত করলে যেমন তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে, রাস্তায় এই যে মৃত্যুর মিছিল তা নিয়ে কখনো সোচ্চার হতে দেখা যায়না।
একদিকে গাড়ীর ফিটনেসবিহিনতা অপরদিকে চালক এবং সহকারীর অনভিজ্ঞতা ঈদের আনন্দ যাত্রাকে বিষাদে ভরে দেয়।
ঈদে বেশী গাড়ীর চাপে উত্তরাঞ্চলের খানাখন্দে ভরা সড়কগুলো হয়ে যায় মৃত্যুকুপ। সাম্প্রতকিকালে, কিছু দূর্ঘটনাপ্রবন এলাকা চিহ্নিত করে বিশেষ ডিভাইডার বসানো হয়েছে, তাতে কতটুকু সুফল আসছে তা বলাই বাহুল্য।
হারুন মিয়াদের বাস টাংগাইল পৌছাতেই রাত হয় ভোর। ঈদের নামাজ আর পাবে না। তবুও খুশি, মা-কে ঈদের নতুন শাড়ী পড়াবে, ছোট ভাই-বোনকে নতুন জামা কাপড় পড়িয়ে আত্মীয় বাড়ী বেড়াতে নিয়ে যাবে। আর নিজের জন্য কেনা জিন্স প্যান্ট আর শার্ট পড়েই ভ্রমন করছে সে।
ঈদের আগেই শিপমেন্ট, দিনরাত খেটে এমনিতেই ক্লান্ত সবাই, তারপর তাড়াহুড়া করে গাড়ী ধরার জন্য ঠিকমত খাওয়াও হয়নি। দীর্ঘ জ্যামে হকারের বাদাম, চানাচুরই ভরসা। ক্ষুধার তীব্রতা শারীরিক ক্লান্তির কাছে হার মানে।
গাড়ী ভর্তি মানুষগুলো কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিল কেউ জানেনা। ঘুম ভাংগে প্রচন্ড শব্দে, তাদের বাসটা দূমড়ে মুচড়ে যায়, রাস্তায় বিকল হয়ে পড়ে থাকা ট্রাকের সাথে ধাক্কা লেগে।হারুন শুধু মনে করতে পারে এ্যাম্বুলেন্স করুন শব্দ আর মানুষের গগন বিদারী আহাজারি।
বছর তিনেক আগে এমনি এক ঈদ যাত্রা হারুনকে চিরতরে পঙ্গু করে দেয়।হাসপাতাল থেকে যখন সে ছাড়া পায় তখন তার দুটো পা কেটে বাদ দেয়া, কতজন প্রান হারিয়েছে তার সঠিক সংখ্যা নাই। এমন দুর্ঘটনায় কেউ আসে উদ্ধার করতে আবার কেউ আসে লুট করতে। তেমনি কোন লুটেরা হারুনের গুপ্ত জায়গায় রাখা টাকা ত্রিশ হাজার হাতিয়ে নিয়ে তাকে নিঃস্ব করে দিয়েছে।
প্রথম ক’দিন মিডিয়ার লাফঝাঁপ এরপর হারুনদের খোঁজ আর কেউ রাখে না। যে হারুন উপার্জন করে চারজনের সংসার চালাত, সে আজ সবার বোঝা।
পাদটীকাঃ
সারা বছর যাদের অক্লান্ত শ্রম আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম মাধ্যম, বছরে মাত্র দুইটা ঈদ যাত্রা তাদের জন্য স্বস্তিদায়ক করা খুব কি কঠিন কিছু?
মালিক পক্ষ, বিজিএমইএ এবং সরকার চাইলেই কি তাদের জন্য সামান্য ভর্তুকি দিয়ে একটু ভাল গাড়ীর ব্যাবস্থা করতে পারেন না ?
যাতে দূরপাল্লায় মুড়ির টিন চলাচল বন্ধ হবে, মাঝপথে বিকল হয়ে অযথা যানজট বাড়াবে না আর অনাকাংখিত মৃত্যুঝুকিও কমবে।
লেখকঃ ম্যানেজমেন্ট কনসালটেন্ট, কমিউনিকেশন অ্যান্ড নেগোশিয়েশন এক্সপার্ট এবং চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার, একটিভা ম্যানেজমেন্ট ডেভলপমেন্ট ইন্সটিটিউটশন।
Leave a Reply