
এম এ মান্নান পাভেল
বাংলাদেশ একটি কৃষিপ্রধান দেশ। এখনো দেশের অধিকাংশ মানুষ কৃষির উপর নির্ভরশীল। কিন্তু একটি দেশের অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতার জন্য শিল্পের বিকাশ অবশ্যম্ভাবী। যদিও দেশ স্বাধীন হওয়ার পর হতে আমাদের অর্থনীতিতে কোন শিল্পই সেরকম প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। একসময় আমরা পাট রপ্তানী করতাম, তখন পাট ছিল আমাদের রপ্তানী আয়ের সবচেয়ে বড় উৎস। কিন্তু কালের বিবর্তনে ৮০–এর দশকের পর হতে তা ক্রমেই হ্রাস পেয়েছে, যা এখন প্রায় শুন্যের কোঠায়। কৃষিপ্রধান দেশ হলেও আমাদের অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা অনেকাংশই পোশাক শিল্পের উপর নির্ভরশীল। অর্থাৎ রপ্তানী আয়ের সবচেয়ে বড় উৎস হচ্ছে পোশাক শিল্প এবং বর্তমান রপ্তানি বানিজ্যে পোশাক শিল্পের একচ্ছত্র আধিপত্য বিদ্যমান। এদেশে সকল শিল্পের পূর্ণাঙ্গ বিকাশ না ঘটলেও পোশাক শিল্পের বিকাশ ক্রমবর্ধমান হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে । কেবল রপ্তানি বানিজ্যের কারনে নয়, এ শিল্পের মাধ্যমে বর্তমানে হচ্ছে হাজারো মানুষের জীবিকার ব্যবস্থা, হচ্ছে হাজারো বেকার যুবকের পাশাপাশি হাজারো নারীর কর্মসংস্থান। পোশাক শিল্প বর্তমানে বাংলাদেশের অর্থনীতির অক্সিজেনে পরিনত হয়েছে। যার মাধ্যমে আমরা বর্তমানে প্রচুর পরিমান বৈদিশিক মুদ্রা অর্জন করছি।
বর্তমান সময়ে বাংলাদেশে অনেক ব্যাংক ও বীমা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। ব্যাংক সমূহ তাদের বিনিয়োগের প্রথম এবং প্রধান হাতিয়ার মনে করছে পোশাক শিল্প প্রতিষ্ঠানকে এবং বিনিয়োগ করে তারা প্রত্যেকেই লাভবান হচ্ছে। সরকারী কিংবা বেসরকারী ব্যাংকের পাশাপাশি দেশে বিদ্যমান বীমা প্রতিষ্ঠানগুলোও ইতিমধ্যে এ শিল্পে বিনিয়োগ শুরু করেছে এবং আশার কথা হচ্ছে পোশাক খাতে বিনিয়োগের ফলে বীমা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রিমিয়ামও কিন্তু দৈনিক বৃদ্ধি পাচ্ছে। ব্যাংক বা বীমা প্রতিষ্ঠানগুলোর পোশাক শিল্প খাতে বিনিয়োগের ফলে যে লাভবান হচ্ছে বা তাদের প্রিমিয়াম বৃদ্ধি পাচ্ছে যাই বলিনা কেন সবি কিন্তু আমাদের অর্থনীতিতে ব্যাপক অবদান রাখছে। উন্নত বিশ্বের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার লক্ষ্যে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার করা হচ্ছে। যা একসময় অর্থনীতিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলবে।
মানুষের বেঁচে থাকার জন্য যে কয়টি মৌলিক চাহিদা রয়েছে, তার মধ্যে বস্ত্র বা পোশাক হচ্ছে অন্যতম। অর্থনীতিতে উত্থান পতন আসতে পারে, কোন এক সময় হয়তো দেশের অর্থনীতি ভংগুর আকার ধারন করতে পারে, টাকা, গাড়ি–বাড়ির চাহিদা কমে যেতে পারে কিন্তু মানুষের পোশোকের চাহিদা কখনো কমবেনা। সবচেয়ে সুন্দর এবং চমকপ্রদ যে বিষয়টি আমাদের অজান্তে ঘটছে আমরা হয়তো কখনো তা অনুধাবন করতে পারিনা, কারন সেভাবে ভেবে দেখার ফুরসত হয়তো হয়ে উঠেনি। মানুষের মৌলিক চাহিদার প্রথমটি হচ্ছে খাদ্য আর তারপরই রয়েছে বস্ত্র বা পোশাক। বেচেঁ থাকার জন্য খাদ্যের যেমন প্রয়োজন তেমনি বস্ত্র বা পোশাকেরও প্রয়োজন অবশ্যম্ভাবী। বর্তমানে আমাদের দেশে প্রায় ৪০ লক্ষেরও অধিক পোশাক শ্রমিক রয়েছে। তারা তাদের প্রথম মৌলিক চাহিদাটি পূরনের জন্য ২য়টির উপর সম্পূর্ণরুপে নির্ভরশীল।
বাংলাদেশ সম্পর্কে হেনরি কিসিঞ্জার একসময় খুব বাজে একটি মন্তব্য করেছিলেন, যা দেশপ্রেমিক প্রতিটি মানুষের অন্তরে দাগ কেটে গেছে। যদি আজ হেনরি কিসিঞ্জার বেঁচে থাকতেন নিশ্চিত তিনি লজ্জায় অবনত মস্তিষ্কে স্বীকার করতেন তিনি যা বলেছেন তা সম্পূর্ণ ভুল এবং এজন্য বাঙ্গালী জাতির নিকট ক্ষমা প্রার্থণা করতেন। হয়তো বলতেন আমাকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দাও, আমি আমার করা মন্তব্যের জন্য অনুতপ্ত, এ দেশের নাগরিকত্ব নিয়ে কিছুটা পাপ মোচন করি। এ কথা বলার বা মন্তব্য করার দুঃসাহস জুগিয়েছে পোশাক শিল্পের বিকাশ, যার ফলশ্রুতিতে আমরা মধ্যম আয়ের দেশে পরিনত হতে যাচ্ছি। কিন্তু এত রপ্তানী বানিজ্য এত রেমিট্যান্স, অর্থনৈতিক সচ্ছ্বলতার পরও কোথাও যেন একটি অশনি সংকেত রয়ে গেছে। বন্ধুর বেশধারী শত্রুরা আমাদের পোশাক শিল্পকে ধ্বংস করার প্রতিনিয়ত নীল নকশা করে চলছে। আর তাদের সাথে যোগ দিচ্ছে আমাদের দেশের কিছু সুবিধালোভী, স্বার্থপর, হীনমনস্ক ব্যক্তি। যারা দেশের চেয়ে নিজের স্বার্থ আগে বিবেচনা করেন। নিজের স্বার্থ দেখতে গিয়ে মাতৃভূমির সাথে গাদ্দারি করছেন প্রতিনিয়ত। এ সুবিধাবাদি, স্বার্থান্বেষী মহলকে যতদিন চিহ্নিত করা না যাবে বর্তমানে পোশাক শিল্পের যে পূর্নিমার চাঁদ আমরা দেখতে পাচ্ছি তা হয়তো বেশিদিন সময় লাগবেনা অমানিশার কাল অন্ধকারে নিমজ্জিত হতে। পোশাক শিল্পে কর্মরত একজন কর্মী হিসেবে নিশ্চয় আমরা কেউ চাইবোনা অমানিশার কাল অন্ধকার আমাদের এ শিল্পকে ঘ্রাস করুক। এক রানা প্লাজা কিংবা তাজরীন ফ্যাশন দিয়ে আমাদের সমগ্র পোশাক শিল্পকে বিবেচনা করা আদৌ সমীচীন হবে বলে আমার মনে হয়না। বিশ্বের এমন কোন রাষ্ট্র নেই যেখানে দুর্ঘটনা ঘটেনা, আমরা কতটুকু তার জানতে পারি। কিন্তু যখনি আমাদের দেশে কিছু হয় তখনি সারা বিশ্বে একটা স্লোগান উঠে সবিই শেষ, এরা কিভাবে কি করছে, এরা মানুষের জীবন নিয়ে খেলছে এ রকম হাজারো কথা। কিন্তু কেউ কি একবার এসে দেখেছে কেন ঘটেছে বা কি কারনে ঘটেছে। যাই হোক যখন অন্য কোন দেশে এরকম কোন দুর্ঘটনা ঘটে তার কতটুকু হাইলাইট করা হয় বা বিশ্ব মিডিয়ায় জাযগা পায় তা ভেবে দেখার সময় হয়েছে। আর আমাদের দেশের পোশাক শিল্পের ছোট বা বড় কোন ঘটনাকে কাদের ইশারায় বিশ্ব মিডিয়ায় হাইলাইট করা হচ্ছে, এদের কে মদদ দিচ্ছে এখনি ভেবে দেখা উচিত। নয়তো সময় চলে গেলে তখন আর কিছুই করার থাকবেনা।
লেখকঃ ব্যবস্থাপক, এইচ আর এন্ড কমপ্লায়েন্স, স্টারলেট এ্যাপারেলস লিঃ
Leave a Reply