
রানা ফরহাদ
( আরএমজি জার্নাল এ যারা অপরের কল্যাণে লিখছেন তাদের মাঝে লেখক অন্যতম। লীন নিয়ে তার এই ধারাবাহিক লেখাটি গত ০২/০২/২০১৮ ইং তারিখে থেকে প্রকাশিত হচ্ছে। আমরা লেখকের লেখনীকে তার মত করেই উপস্থাপন করতে পছন্দ করি তাই কোন প্রকার এডিটিং ব্যতিরেকে লেখাটি হুবুহু প্রকাশিত হবে। মজাদার এ লেখার মাধ্যমে আশাকরি অনেকে অনেক কিছু জানতে পারবেন।)
একদা এক দ্যাশ আছিলো, সেই দ্যাশে আছিলো অনেক গার্মেন্ট ফ্যাক্টুরী। সেই ফ্যাক্টুরীর জন্য আছিলো এক কনসালটেন্ট। সেই কনসালটেন্টরে ডাইকা নিলো এক গার্মেন্ট ফ্যাক্টুরী। কইলো, “হামারা এক বহুত জরুরী কাম হ্যায়, বহুত ইমপোরটেন কাম হ্যায়। ফ্যাক্টুরীকা ইফিশিয়েন্সি কাল্কুলেটিং কারনা হ্যায়। হামারা লীন করণা চাহাতে হ্যায়। ইসকো লিয়ে স্যাম্পুলকা স্যাম ক্যাল্কুলেটিং কারনা হ্যায়।”
ফ্যাক্টুরিকা গুরুজন অনেকভাবে টেশটুশ নিয়া, টিপে টুপে দেইখা কনসালটেন্ট এর গিয়ান গরীমা পরীক্ষাপূর্বক এই মর্মে পৌছাইয়া গেলো যে কনসালটেন্টরে দিয়া তাগো কাম হোগা। যা হোক, এরপর আসিলো সেই মাহেন্দ্রক্ষন, নাজিল হইলো সেই মহান প্রশ্ন, “আপকা হাদিয়া কিতনা?”
কনসালটেন্ট কহিলো, “আজ্ঞে বাবু, হামি তো মামুলী কর্মচারি আছি, হামার হুজুর আপনাকে হাদিয়া বিস্তারিত জানাইবেক”।
খরচ জানানোর পর শুরু হইলো মুলামুলি। আধা বেকার নিম্ন মধ্যবিত্ত কনসালটেন্ট অনেক সাহস করিয়া চাল ডালের বাজার দর হিসাব করিয়া মোটামুটি একখানা সন্মানজনক বিল পাঠাইয়া ছিলো। ফ্যাক্টুরী ম্যানেজমেন্ট ফোন করিয়া দর জানাইলো হাকানো দরের অর্ধেকের চেয়ে কিঞ্চিত কম।
এই যে শুনুন! লীন কিন্তু ওখানেই মুখ থুবড়ে পড়ে গ্যাছে। আমরা এই দেশে বলি ‘লীন প্রোডাকশন সিস্টেম”। আমরা আসলে সেখানেই হেরে যাই। কোথাও দু’কলম পড়া কোন একজনের মুখ থেকে শুনে আমরাও বুলি আওড়াচ্ছি, কিন্তু নিজেরা ক’জন নিম্নোক্ত বই গুলি পড়ে দেখেছি?
১। দ্যা মেশিন দ্যাট চেঞ্জড দ্য ওয়ার্ল্ড
২। লীন ম্যান্যফেকচারিং দ্যাট ওয়ার্ক্স
৩। টয়োটা প্রোডাকশন সিস্টেম (তাঈচি ঊনো)
৪। ইন্ট্রোডাকশান টু কোয়ালিটি কন্ট্রোল (কাওরো ইশিকাওয়া)
যা হোক বইয়ের মার্কেটিং করা বাদ দেই। আমরা ক’জন ‘লীন এইচ আর” শব্দটার সাথে পরিচিত? জাস্ট ইন টাইম কি শুধুই প্রোডাকশন? কর্মীর বেতন, তার ক্যারিয়ার, প্রমোশন, ট্রান্সপোর্ট, বিনোদন এসবের সাথে কি জাস্ট ইন টাইমের কোন সম্পর্ক নেই?
একদা আমার এক সহকর্মী খুব আক্ষেপ করে বলেছিলেন যে ফ্যাক্টরী ওয়ারর্কারের পিকনিকে আমরা প্লান করি বিরিয়ানীর আর যে পরিমান মাংস কিনি তাতে বিরিয়ানি হয়ে যায় তেহারী।
যা হোক, যারা লীন করতে চাচ্ছেন তারা খুব ভালো করে টয়োটা সিস্টেম বুঝুন। পর্ব -০১ এ মনোজুকুরী নিয়ে শুরু করেছিলাম। বর্তমানে টয়োটা যে ক’টি টুলস নিয়ে চর্চা করছে তার একটি হচ্ছে এই মনোজুকুরী। যখন কোন কর্মী প্রতিষ্ঠানে খুব উন্নতমানের পণ্য তৈরী করে গর্ব অনুভব করে এবং প্রতিষ্ঠানের কন্টিনুয়াস ইম্প্রুভমেন্ট এর যাত্রায় সামিল হয়ে তুমুল আত্মসন্মান উপলব্ধি করে তখনই তাকে মনোজুকুরী বলে।
এখন আসি শূরুতে এত বড় একটা গল্প কেনো বল্লাম। উক্ত কনসাল্টেন্ট দাবিকৃত ফী কি আসলেই যুক্তিযুক্ত এটা নিয়ে ঐ ফ্যাক্টরী ম্যানেজমেন্ট কি ভেবেছেন? অথবা দাবিকৃত ফী এর অর্ধেকেরও কম অফার করা কি কনসাল্টেন্টকে অপমান করা নয়? এখন যদি ঐ কনসালটেন্টকে দাবিকৃত ফী-এর বিনিময়েও কাজটা দেয়া হয়, কাজের মান নিয়ে আপনি কি নিশ্চিত (এই দর কষাকষি কি কাজে কোন প্রভাব ফেলবে না)?
এই দেশে “গার্মেন্ট ফ্যাক্টরীতে কাজ করি” এইটা সামাজিকভাবে গ্রহনযোগ্য হতে কত বছর লেগেছে?এদেশে গার্মেন্ট জব কি এখনো আত্মসন্মানের জায়গাতে পৌছাতে পেরেছে? বা কোন একটা গার্মেন্ট ফ্যাক্টরী নিজে কি নামে ব্রান্ড হচ্ছে?
বুঝিয়ে বলি, যে গ্রামীনফোন চাকরি করে সে কিন্তু বলে না যে মোবাইল ফোনে কোম্পানীতে চাকরি করি, বলে গ্রামীনফোন। একইভাবে ইউনিলিভার, ব্রিটিশআমেরিকান টোবাকো, আকিজগ্রুপ, নাবিস্কো, সোনালী ব্যাংক, এভাবে প্রতিষ্ঠানের নাম দিয়েই কর্মীরা পরিচয় দেয়। খুব কম পাবেন এটা গার্মেন্ট প্রতিষ্ঠানে। উত্তর আসে আমি একটা গার্মেন্টে চাকরি করি। তারপর নাম আসে। হয়তো বলবেন যে গার্মেন্ট তো এক্সপোর্ট নির্ভর। দেশের মাঝে ব্রান্ডিং ডিং ডিং ডিং… সেক্ষেত্রে সম্পূরক প্রশ্নঃ শ্রীলঙ্কার প্লেয়ারদের জার্সি দেখেছেন?
সে যাক, আমরা কি আসলেই সেই আত্মসন্মান ও গর্ব-এর জায়গায় পৌছাতে পেরেছি? ইংরেজীতে “ক্রাফটসম্যানশীপ” বলে একটা শব্দ আছে। যার বাংলায় অর্থ প্রকাশ করা আমার জ্ঞানের বাইরে। শুধু এটুকু বলি, এই শব্দটার সাথে দক্ষতা অর্জনের একটা বিষয় আছে। এটা এমন একটা দক্ষতা অর্জনের গর্ববোধের সাথে জড়িত যা বলার সময় একজন কর্মীর বুক গর্বে ফুলে ওঠে। যেমনটা এদেশের একদা দাবি করতো মসলিন কাপড়ের কারিগর। কিংবা দাবি করে ইন্দোনেশিয়ার গার্মেন্ট সেক্টর!
আমরা কি প্রতিষ্ঠানে এমন ক্রাফটসম্যানশীপ চর্চাকে উৎসাহিত করতে পারবো? এখনো আমরা তুমুল আক্ষেপ নিয়ে বলি যে ওয়ার্কার থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মীদেরকে প্রশিক্ষণ দিয়ে কি করবো? তারা তো থাকে না। চলে যায়। অভিমানী জাতি আমরা, কি তুমুল অভিমান আমাদের “চলে যায়, থাকে না”। একবারো প্রশ্ন করি না যে ‘কেন থাকে না?”
জাপানে আমি খুব অল্প সময় খুবই অল্প সময় কাটিয়েছি। কিন্তু যথাসম্ভব তাদের সাথে মেশার চেষ্টা করেছি। ওখানকার ফ্যাক্টরী ভিজিট করার সময় একটা দূর্দান্ত বিষয় চোখে পড়েছিলো। সেই বিষয়টিই আসলে পার্থক্য গড়ে দেয়। দেখুন আমাদের ফ্যাক্টরীতে কোন সমস্যা হলে যে প্রশ্ন গুলা করা, প্রশ্নগুলা যিনি জিজ্ঞাসা করেন আর যে বাচনভঙ্গীতে জিজ্ঞাসা করেন, তা অনেকটা দোষীকে খুজে বের করার স্টাইলে, মনে হয় রিমান্ড চলছে।
আমি দেখেছি 5WHY এর ব্যাবহারের সময়, প্রশ্ন গুলা করা হয় অত্যন্ত সন্মানের সাথে। যখন সুপারভাইজার বা ম্যানেজাররা কর্মীদের প্রশ্ন করেন তাদের আচরনেই প্রকাশ পায় যে তারা কর্মীর প্রতি সন্মান ও খেয়াল রাখছেন। যেমন রাখেন শিক্ষক শিক্ষার্থীদের প্রতি (এদেশের হাল আমলের শিক্ষক ছাত্র না, আগের আমলের… হে হে হে) । এমনভাবে প্রশ্ন করা হয় যেন উত্তরটা কর্মীরা জানতই কিন্তু এই মূহুর্তে মনে আসছে না। একটু হিন্টস দিলেই মনে পড়ে যাবে।
আমরা যারা একটু সিনিয়র আছি তারা প্রায়ই বলি, “এই ছোট্ট বিষয়টা পারো না, আমি তোমাদের মত থাকতে কি করতাম জানো মিয়া?”
আমরা আসলে ধরে নেই যে কর্মী স্বক্ষমতা নেই বিষয়টা বোঝার। এমন বিষয় আপনি জাপানে পাবেন না। তারা সমস্যা হলেই ধরে নেয় যে কর্মীর সামর্থ্য আছে, হয়তো কোন কারণে বিষয়টি এড়িয়ে গেছে। সমস্যা সমাধানে কর্মীদের নিজেদের ও তাদের প্রসেসের উভয়ের গুরুক্ত বুঝিয়ে দেয়া হয়। কর্মীকে সমস্যা সমাধানের পদ্ধতি শিখিয়ে দেয়া হয়, এরপর তাকে উৎসাহিত করা হয় তা সমাধানের জন্য।
আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলাতে একজন ফ্রেশ গ্রাজুয়েট যখন যোগ দেয় সে দুটি বিষয় জানেঃ
১। তার বেতন
২। অফিস শুরুর সময়
হ্যা অনেক ব্যতিক্রম আছে হয়তো। কিন্তু সেগুলা তো ব্যাতিক্রম, তাই না?
পূর্বের একটা প্রতিষ্ঠানে আমি আমার বিভাগে অত্যন্ত এটা প্রচলন করেছিলাম যে, একজন কর্মী আমার বিভাগে এসে বেতন জানবে, দৈনিক কাজের সময় জানবে, আগামী দু বছরে কি কি শিখতে হবে, কিকি করতে হবে, তার কাজ কি কি বিষয় দ্বারা মূল্যায়িত হবে এবং বেতন ও পদ কিসের ভিত্তিতে বাড়বে।
হ্যা, আমি সেখানে দীর্ঘদিন কাজ করতে ব্যর্থ হয়েছি। কিন্তু সেই সময়ে নিয়োগকৃৎ কর্মীরা অত্যন্ত কাজ শিখেছে মনে আনন্দে। আর তার প্রমান তাদের বর্তমান অবস্থান ।
মনোজুকুরী ও হিতোজুকুরি কাজে দিয়েছিলো। কিন্তু সত্য স্বীকারে দ্বিধা নেই, আমরা বা আমি ভালো ফিনিশার নই।
যা হোক, গত পর্বের প্রশ্নের জবাব দেই, একজন সুইং অপারেটর আপনার প্রতিষ্ঠানে আসে দুইটা কাজ করার জন্যঃ
১। সুইং
২। এনডন সিগনাল দেয়ার জন্য।
এর বাইরে যদি তাকে দিয়ে কোন কাজ করান তাহলে সেটা মুডা মানে অপচয়। একজন সুইং কর্মীকে যদি জিজ্ঞাসা করা হয় তার দায়িত্ব কি? আর সে কি কি কাজ করছে?
দেখবেন সেখানেও লীন নিজেই লীন হয়ে লীন্ট-এর মতো অবস্থা হয়ে আছে।
এত কথা বলার একটাই উদ্দেশ্য, দিনশেষে লীন-এর টুলস গুলা হচ্ছে কেবল মাত্র টুলস। অনেকটা ক্যালেন্ডারের পাতার মত।
আপনি যদি আপনার এইচ আর সিস্টেমে লীন না আনতে পারেন তাহলে সাময়িকভাবে লাভবান হবেন মাত্র। যারা লীন নিয়ে বিয়াফোক আগ্রহী তারা মনোজুকুরী-হিতজুকুরী-র পাশাপাশি হারাদা পদ্ধতি নিয়েও একটু পড়াশোনা করতে পারেন। দ্বীন দুনিয়ার অশেষ নেকী হাছিল হওয়া কিঞ্চিৎ সম্ভাবনা আছে।
যাইজ্ঞা সামনের দিকে আউজ্ঞা। সেই যে এক কনসালটেন্ট আছেলো। তাঈনরে এখটা খোম্পানী থাকি মেইল করছুইন খাম দিবার লাগি। বুইচ্চন্নি, টেখাটুকা নিয়ে বাক্কা আলাপ অইবো রে বা। তারার লাগি দুয়া খরবাঈন। আর আমরার লিখা ফরবাইন। লিখা ফড়িয়ে বালা লাগিলে অনুরোধ করইনযেন। ফরর লিখা পাইবার লাগি বাক্কা দেরী অইবো। বালা থাকুইন।
Leave a Reply