
সাইফুল ইসলাম রোমেন
আমার বাবা সরকারী চাকরি করতেন, ৯টা ৫টা ডিউটি। আমাদের পরিবার চট্টগ্রামে থাকত। ২০০৫ সালে বাবা ঢাকায় ট্রান্সফার হয়ে যাবার কারনে পুরো পরিবার ঢাকায় চলে আসে। আমি তখন একটা ফ্যাক্টরির হেড অফিসের মার্চেন্ডাইজার। তো সেই ঢাকা আসার পর সবাই একসাথেই থাকা শুরু করলাম। প্রথম রাতে আমি বাসায় ফিরলাম রাত দশটায়। বাবা অবাক হয়ে দরজা খুলে জিজ্ঞাসা করলেন “এত দেরী কেন?” আমি বললাম “কাজ ছিল”। বাবা বলল “আমরাও তো ৩০ বছর ধরে কাজ করছি, এত রাত তো হয় নাই!!’ আমি জবাব দিলাম না। কী জবাব দিব?
পরের রাতে ভাবলাম বাবা যাতে প্রশ্ন করতে না পারে তাই আগে আগে বাসায় যাই। সেদিন আরো দেরি হয়ে গেল। সেই রাতে বাসায় ফিরলাম রাত একটায়!
ততক্ষনে বাবা ঘুমিয়ে গেছে। সদর দরজা খোলা ছিল, মানে আমার জন্য খোলা রেখেছিল। পরে বাবা এ ব্যপারে আর কোন প্রশ্ন করেন নি।
বিয়ের সময় ঐ একই অবস্থা। বিয়ে করেছি সোয়েটারের পীক সিজনে। এই সময় দিন রাত ডিউটি থাকে। বিয়ে তো আর পীক সীজন অফ সীজন বোঝে না! বিয়ের পর পর বৌয়েরও একই প্রশ্ন “এত রাত পর্যন্ত কী এত কাজ কর?”
জবাব দেয়ার মত কোন কিছু খুঁজে পেলাম না।
পীক সিজনের ছয় মাসের মধ্যে ডিউটি থাকে ১৭০ দিন। মানে এই ৬ মাসে ২৪ টা শুক্রবার ও চারটা সরকারী ছুটি থাকা সত্বেও ছুটি পাই মোটে ১০ দিন, বাকীগুলো ফ্রী! এই ১৭০ দিনের মধ্যে ফ্যাক্টরিতে থেকে যাই কম হলেও ৭০ দিন। অর্থাৎ এত রাত পর্যন্ত ডিউটি চলে যে, বাসায় ফেরার মত এনার্জী থাকে না। আর রাত দুইটা তিনটার সময় বাসায় ফিরেই বা কী হবে, সকালে তো অফিস মাফ নেই, আবার যেতে হবে, তাই ফ্যাক্টরিতেই থেকে যাই। কিছু কিছু ফ্যাক্টরিতে রাতে থাকার মত আবাসিক ব্যবস্থা আছে, কিছু কিছু ফ্যাক্টরিতে নাই। যেসব ফ্যাক্টরিতে আবাসিক ব্যবস্থা আছে সেখানেও সব সময় শোয়ার সুযোগ হয় না। উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা যারা যারা থাকেন তার মিলে একত্রে যেকোন রুমে শুয়ে পড়ি। যেহেতু ঐ সময়ে প্রচুর গরম থাকে তাই আমাদের ঐ সময়ে শোয়ার বেস্ট চয়েজ থাকে অফিসের কনফারেন্স রুম। কারণ ঐখানে অবশ্যই এসি থাকে। আর কনফারেন্স রুম এর পর পরই আছে এমডি স্যারের রুম। পুরো ফ্যাক্টরির সব এসি নষ্ট থাকলেও এই দুই রুমের এসি কখনো নষ্ট হয় না!
আর কীভাবে শুই, তা শুনতে চান? কি মনে হয়, কাঁথা বিছানা বিছিয়ে? না ভাই, সেই সৌভাগ্য হয় না। আমরা সরাসরি ফ্লোরে শুয়ে পড়ি। মাঝে মাঝে ফ্লোরে কার্টুন বিছিয়ে শুই। রাস্তার ভাসমান মানুষরা যেভাবে বালিশ ছাড়া শোয় আমরাও সেভাবে বালিশ ছাড়াই শুই। তবে যেহেতু গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে চাকরি করি তাই জামা কাপড় মাথার নিচে দেয়ার সৌভাগ্য হয়। অবশ্য হাতের কাছে দুই একটা সোয়েটার রাখি যাতে শেষ রাতে শীত লাগলে এগুলো গায়ে দিতে পারি!
এ বিষয়ে একটা মজার ঘটনা শেয়ার করি-
নাইট করলে অনেক সময় আমাদের সাথে বায়িং কিউসি নাইট করে, উদ্দেশ্য কাজ শেষ হলে ইন্সপেকশন করবে। রাত যত গভীর হয় চোখে তত ঘুম আসে। শেষ পর্যন্ত কিউসি সাহেব বললেন “আমি একটু শুই, ইন্সপেকশনের জন্য রেডি হলে আমাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে দিবেন।”
শেষ রাতে মাল রেডি, ইন্সপেকশন হলেই মাল চলে যাবে, ফ্যাক্টরির সামনে শিপমেন্টের ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু কিউসিকে ঘুম থেকে ওঠানো যাচ্ছে না। উনি মাত্র এক ঘন্টা আগে ঘুমিয়েছেন। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। উনি ঘুমিয়ে ঘুমিয়েই বললেন “আপনারা ইন্সপেকশন করেন”
তো আমরা ওনার কথা মত ইন্সপেকশন করলাম।
কিউসিকে বললাম “ইন্সপেকশন শেষ’
উনি ঘুমিয়ে ঘুমিয়েই বললেন “এবার রিপোর্ট করেন”
আমরা রিপোর্ট করলাম।
ওনাকে রিপোর্টের কথা বলার পরে উনি বললেন ‘কাগজটা এদিকে দেন, সাইন করে দেই”
উনি চোখ অর্ধেক খুলে রেখেই সাইন করে দিলেন। মাল ট্রাকে উঠিয়ে আমরাও ঘুমিয়ে পড়লাম।
পরদিন (কয়েক ঘন্টা পরে) ঘুম থেকে উঠে কিউসি সাহেব বললেন “মাল কই? ইন্সপেকশন করাবেন না?” উনি রাতের কথা ভুলে গেছেন!
লেখকঃ হেড অফ প্রোডাকশন, ফ্রেনচ ফ্যাশন কিটিং পাইভেট লিমিটেড
Excellent
সুন্দর মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। অনুগ্রহপূর্বক আরএমজি জার্নালের সাথে থাকুন। আপনাকে আমাদের লেখা পড়ার ও সম্ভব হলে লেখার অনুরোধ জানাচ্ছি । ভাল থাকবেন। শুভকামনা।