
তৌহিদুল ইসলাম চঞ্চল
এই লেখাটি অদ্য ২৪ ফেব্রুয়ারী ২০১৮ দৈনিক শেয়ারবিজ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
জীবন সৃষ্টিকর্তার দেওয়া এক পরম আশীর্বাদ। যেসব প্রাণীর জীবন আছে তার মধ্যে শুধু মানুষের ক্ষেত্রে জীবন নিয়ে অনুভূতিটা আমরা বুঝতে পারি, কারণ মানুষ তা বলতে কিংবা প্রকাশ করতে পারে। কিন্তু মানুষ ছাড়া অন্য প্রাণীদের কাউকে জিজ্ঞেস করলে সে আমাদের প্রশ্ন বুঝল কি না, সেটাই আমরা অনুধাবন করতে পারব না; তাই তার জীবনটা কেমন, তা বুঝব কেমন করে! যেহেতু মানুষ তার জীবন নিয়ে অনুভূতিটা প্রকাশ করতে পারে, তাই আমার দৃষ্টি আজ তাদের দিকেই। আর তার একটি বিশেষ কারণ আছে সে কথা একটু পরে বলছি। জীবন নিয়ে কেউ শতভাগ সুখী, এটা বলা বা প্রমাণ করা দুষ্কর বিষয়। কেউ বলে ‘চলছে জীবন’, কেউ বলে ‘এই তো আছি’, কেউ বলে ‘আর চলে না’, কেউ বলে ‘অনেক ভালো আছি’, কেউ বলে ‘এই জীবন দিয়ে আর কী হবে!’ জীবন নিয়ে ইতিবাচক মন্তব্যের চেয়ে নেতিবাচক মনোভাবটাই বেশি পরিলক্ষিত হয়। এর মূল কারণ কেউ তার নিজের অবস্থানে সুখী নয়, বা তাকে সুখী থাকতে দেওয়া হচ্ছে না। কেন সুখী নয়, সে কারণ খুঁজতে গেলে তা এ ধরনের কয়েক হাজার লেখা দিয়েও পুরোপুরি প্রকাশ করা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না।
সৃষ্টিকর্তার উপহার এই পরম আশীর্বাদ জীবনকে সুখী রাখতে প্রথম যে জিনিসটি দরকার তা হলো জীবিকা। জীবিকা আছে তো জীবন আছে, জীবিকা নেই তো জীবন আর নিজের থাকে না পরগাছার মতো অপরের ওপর নির্ভর করে থাকতে হয়। খাদ্যশৃঙ্খলের স্তরগুলোতে সবার শুধু একটি চাহিদা, তা হলো আহার/ খাবার/ খাদ্য। এ ছাড়া জীবন নিয়ে এই ধরিত্রীতে বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। জীবনীশক্তির উৎস হলো এই খাদ্য। আর সেই খাদ্যের জোগান দিতে সবার ছুটে চলা কখনো এক মাইল কখনও সহস্র মাইল ছুটে চলছে মানুষ খাদ্যের জন্য, জীবিকার সন্ধানে। জীবনে একটু শান্তি, একটু সচ্ছলতা ও একটু ভালো থাকার জন্য মানুষ ছুটছে তো ছুটছেই। শুধু তো খাদ্যের জন্য কাজ করলে হবে না, বাকি প্রয়োজন তো আছেই, তাই না? এখন প্রশ্ন দাঁড়িয়েছে কোনটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ জীবন না জীবিকা? কোনটার প্রায়োরিটি আগেজীবন না জীবিকা? বলবেন জীবিকা ছাড়া অর্থপ্রাপ্তি হবে না, খাদ্য কিনতে পারবেন না, তাই জীবনও চলবে না। আর জীবন যদি না-ই থাকে তবে জীবিকা দিয়ে কী হবে! তাই তো বলি কোনটা আগে মানুষ না কাজ!
সবিতা (ছদ্মনাম) জার্মানিভিত্তিক বড় বায়িং হাউজে কাজ করেন। মাথার যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে আছেন বেশ অনেকদিন। ডাক্তাররা অসুখটাও ধরতে পারছেন না। বড্ড বিপদ চারদিকে। কাল তাকে রিং করে বললাম, ‘ব্যথাটা তো বোন বহু দিন থেকে, তবে ভালোভাবে চিকিৎসা করাচ্ছেন না কেন?’ উত্তরে তিনি বললেন, ‘ভাইয়া অফিস ছুটি দিতে চায় না, কী যে হলো আমার বাঁচব কি না জানি না। অনেক বড় এক ডাক্তার এসেছেন এক হাসপাতালে। তিনি সিটি স্ক্যান করে তারপর রোগটা ধরলেই না চিকিৎসা!’ আমি দোয়া করি পরম করুণাময় এই ডাক্তারের উসিলায় তাকে সুস্থ করে দিন। এখানে আমার প্রশ্ন জীবিকা আগে, না জীবন? কারণ সবিতা যদি চাকরি ছেড়ে দিয়ে চিকিৎসা করাতে যান, তবে তিনি চিকিৎসার খরচ বহন করতে পারবেন না। তাহলে তার জীবনও বিপন্ন হবে। এখন এই অফিসের এথিক্যাল প্র্যাকটিসের বিষয়ে আপনি কী বলবেন? যারা নিজেদের সাপ্লায়ার ফ্যাক্টরিদের বলছে, ‘আগে জীবন তারপর কাজ।’ বলছে শ্রমিকদের সব ছুটিছাটা ঠিকমতো দিতে হবে। ১০ ঘণ্টার বেশি কাজ করানো যাবে না। সে এক বড় ফর্দ। ফর্দ না ঠিক, এটাই আইন। বাংলাদেশের শ্রম আইন তারা আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, সঙ্গে ধরিয়ে দেয় নিজেদের কোড অব কন্ডাক্ট, আর নিজের অফিসে কাজের নেই কোনো অন্ত। সকাল থেকে রাত দশটা অবধি কর্মীদের খাটিয়ে নিচ্ছে এসব কোম্পানির ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ। অসুস্থ হলেও সেই অসুস্থ শরীর নিয়ে কাজ করতে হবে। কাজটা অনেক জরুরি আর তা হলো, সাপ্লায়ার কোম্পানিগুলো আইন মেনে চলছে কি না তা মনিটর করাÑ‘এক গাদা রিপোর্ট, শেষ করো তারপর বাড়ি যাও।’ ‘কমপ্লায়েন্স, কমপ্লায়েন্স’ বলে উচ্চ স্বরে যারা সেøাগান দেন, তাদের নিজের ঘরে কমপ্লায়েন্স কতখানি কার্যকর তা দেখার কে আছে! এখন সবিতার ক্ষেত্রে নিশ্চয় বলবেন, আগে জীবন তারপর জীবিকা!
এই চিত্র কম-বেশি অনেক করপোরেট হাউজে! দেশি-বিদেশি, নামি-বেনামি সে সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। কাকডাকা ভোরে যে মানুষগুলো বাসা থেকে বের হয়, তারা অর্ধমৃত অবস্থায় বাসায় ফেরে রাত ১২টায়। এই তো জীবন।
কিছুদিন আগে এক নিউজ পোর্টালে দেখলাম, ইউরোপীয় আরেকটি আরএমজি-সংশ্লিষ্ট লায়েসন অফিস কর্তৃপক্ষ তাদের একজন ব্যবস্থাপক, যে কিনা প্রায় দশ বছর সেখানে কাজ করেছেন তাকে হুট করে একদিন বলল, ‘আগামীকাল থেকে আসার দরকার নেই।’ শুধু তা-ই নয়, সে পেল না তার চাকরির অবসান-সংক্রান্ত কোনো বেনিফিট! আর এ যদি একজন শ্রমিকের ক্ষেত্রে হতো তার পাশে বিভিন্ন সংগঠন থেকে শুরু করে খোদ ক্রেতা সংগঠনের প্রতিনিধিও তাকে তার পাওনা তাড়াতাড়ি বুঝিয়ে দিতে বলতেন। বেচারা ব্যবস্থাপক। যার জন্য এত দিন নিরলস কাজ করে গেলেনÑরাতকে রাত না মনে করে, খাওয়া-নাওয়া ছেড়ে শুধু কাজ আর কাজ, সেই অফিস আজ তাকে বলছে, ‘কাল থেকে আসবেন না।’ এত সহজ! এটা কোন এথিকসে আছে বলতে পারেন? যে মানুষটি চাকরি হারালো তার সংসার আছে, তার চাহিদা আছে এসব এখন সে কীভাবে মেইনটেইন করবে, বলতে পারেন? এখানে নিশ্চয় আপনার জীবিকাটাকে বেশি প্রয়োজনীয় মনে হবে!
আরও আশ্চর্যজনক কিছু উদাহরণ আছে, শুনবেন? বলেই ফেলি একটি, কী বলেন? করিম সাহেব এক কোম্পানির জিএম। ৩০ বছর সেখানে কাজ করছেন, বয়সের ভারে একটু নুয়ে গেছেন, তাই আগের মতো কাজের গতি নেই। বেতন তিন লাখ টাকা। কী করবে বলেন, ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা এখনও শেষ হয়নি। এই মুহূর্তে চাকরি ছাড়লে তাদের পড়াশোনায় ব্যাঘাত ঘটবে। তাই অগত্যা চাকরি করা। মালিকের পছন্দের এক লোক তাকে বুদ্ধি দিলেন পাঁচ ভাগ কম বেতনে একজন ম্যানেজার রাখলে করিম সাহেবের থেকে পাঁচগুণ বেশি কাজ করতে পারবেন কী দরকার এই বোঝা টেনে। মালিকও ব্যাপারটা অনুধাবন করে ড্রাইভারের মাধ্যমে করিম সাহেবকে বিষয়টি জানালেন। ড্রাইভার বললেন, ‘স্যার, কাল থেকে আপনার বাসায় গাড়ি যাবে না!’ বুঝেছেন ব্যাপারটা, মানে কাল থেকে তার চাকরি নেই। এত সহজ! এই হলো নৈতিকতা! যে মানুষটি তার জীবনীশক্তির পুরোটা একটি সংস্থার জন্য উজার করে দিলেন, এই তার পরিণতি! করিম সাহেবের ক্ষেত্রেও জীবিকার বিকল্প নেই। জীবিকা ছাড়া তিনি তো একটা দিনও চলতে পারবেন না, তাই না?
এখন সবিতা যদি ছুটি পেতেন, তাহলে হয়তো অনেক আগে সুস্থ হতে পারতেন; পাননি তাই আজ তার জীবন বিপন্ন। ওই ম্যানেজার সাহেবের ক্ষেত্রে তাকে নোটিস পিরিয়ডের সময় দেওয়া হলে আর তার পাওনাদি বুঝিয়ে দেওয়া হলে তিনি আরও কিছুদিন সেই টাকা দিয়ে চলতে পারতেন, আর তত দিনে একটা চাকরি খুঁজে নিতেন। সবচেয়ে বড় কথা তিনি তার নৈতিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। আর করিম সাহেবের ক্ষেত্রে বেসরকারি চাকরিজীবীদের যদি অবসরকালীন সুবিধা থাকত, তবে এত দিন তার চাকরি করার কথা নয়, তা-ই নয় কি? তিনিও তো ওই ম্যানেজারের মতো তার চাকরির অবসান-সংক্রান্ত সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত।
জীবিকা পরিবর্তন হয় তা প্রাইভেট সেক্টরের একটি স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু বঞ্চনার যে খেলা বিভিন্ন জায়গায় চলছে তা রুখবে কে? কোন আইন? জীবিকার সঙ্গে যে টানা-হ্যাঁচড়া চলছে তা রুখবে কে?
এখানে আমরা যারা চাকরিজীবী আমাদের মূল সমস্যা হলো মালিক যখন যা বলে আমরা মেনে নিতে বাধ্য হই চাকরি বাঁচানোর জন্য (ভুক্তভোগীর সহকর্মীদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য) এবং একটা সময় আমরা যা প্রতিষ্ঠা করি তা আমাদের ক্ষেত্রেও কার্যকর হয়। আমরা শ্রমিকের স্থানও যেমন পাই না, তেমনি নিজেদের অধিকারও প্রতিষ্ঠা করতে পারি না। কিছু প্রভাবশালী মালিকের ক্ষেত্রে এমনকি অমানবিক আচরণের কথাও শোনা যায়। এ যেন এমন যে আপনি যাকে দিয়ে একটি লিচুগাছের পরিচর্যা করালেন, তাকে একটি ফলও খেতে দিলেন না। অনিশ্চিত দোদুল্যমান বেসরকারি চাকরিজীবনে চাকরি টিকিয়ে রাখার প্রাণান্ত চেষ্টা না করে অনেকের উপায়ও থাকে না। যেসব প্রতিষ্ঠানে বড় পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট ও প্রাসঙ্গিক কাজের অভিজ্ঞতাকে বিবেচনা করা হয় না, কিংবা কোনো বিদেশিকে নিয়োগ দেওয়া হয়, সেখানে অবস্থা আরও দুর্বিষহ হয়। অবস্থা বেগতিক। বিশেষ করে জিএম বা সমমানের যারা তাদের চাকরি কচুপাতায় পানির মতো টলমল! সময় কী চাইছে, আমাদের পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে, তা নিয়ে ভাবার সময় চলে এসেছে। চালের দাম স্থিতিশীল বা কমানোর মতো নির্বাচনী প্রচারণায় বেসরকারি চাকরিজীবীদের জন্য কিছু করার প্রতিশ্রুতি আমরা বরাবরই পাই, যা আগামী, আগামী এবং আগামীতেই আটকে আছে। আমি হতাশ নই, তবে বলতে চাই জীবন বাঁচাতে যে জীবিকা, তা নাগরিক অধিকার, মানুষ হিসেবে অধিকার; আর এই অধিকার নিয়ে যে খেলা চলছে, তা বন্ধ করুন।
মানবসম্পদ প্রশিক্ষক
Leave a Reply