
রানা ফরহাদ
গার্মেন্ট শ্রমিকদের মজুরী কাঠামো পূণনির্ধারনের জন্য বোর্ড গঠিত হয়েছে। নতুন বোর্ড নতুন মজুরী কাঠামো ঠিক করার পেছনে ৫টি বিষয় নজরে রাখবেন বলে দেখলাম। ইনফ্লেশন রেট, লিভিং এক্সপেন্স, বাড়ি ভাড়া, কারখানার সক্ষমতা ও অর্থনৈতিক সূচক। প্রথম ও পঞ্চম বিষয়ে আমি আসলেই অজ্ঞ। মাঝের তিনটি নিয়ে আজ একটু বক বক করতে চাই।
লিভিং ওয়েজেস একটি দারূণ আলোচিত বিষয়। আমি গার্মেন্টে চাকরি করছি প্রায় এক যুগ। সেই প্রথম থেকেই এই শব্দটির সাথে আলাপ পরিচয়। শব্দটি সম্পর্কে আমার নিজস্ব ধারণাটাও দারুণ । ইহা এমন একটি বিষয় যা শুনতে ভালো লাগে, পাইতেও ভালো লাগে কিন্তু দিতে ভালো লাগে না। এদেশের যতগুলি গার্মেন্ট কারখানা আছে তা মোটামুটি ঢাকা, সাভার, গাজীপুর, ময়মনসিংহ, নারায়নগঞ্জ ও চিটাগংসহ আর কিছু জেলায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। লিভিং এক্সপেন্স নির্ধারণে আশা করি এ সকল শহরগুলির কথা মাথায় রাখা হবে। মাওনা-শ্রীপুর-ভালুকা অঞ্চলের মত কম ব্যয়বহুল শহর যদি মাথায় থাকে তো বিপদ। আবার ঢাকা শহর থেকে গার্মেন্ট কারখানাকে স্থানান্তর করা হবে এই অজুহাতে যদি এখানকার ব্যয়বহুলতাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া হয় তবে সেটাও ভুল হবে বলে আমি মনে করি। (এ ক্ষেত্রে আগে স্থানান্তর, পরে তার হিসাবে বিশ্বাসী আমি)।
এর পরের বিষয়টি যেন ভিশাস সাইকেলে ঘূর্ণণরত। বাড়ি ভাড়া বিষয়টিও আমার কাছে দারুণ মজার! এ শহরে আমিও ভাড়াটে। তাই বাসাভাড়া কলিজার ঠিক মধ্যবিন্দুতে কই-মাছের কাঁটার মত বিঁধে থাকে বারোমাস। দেখুন, একটা বাসার ভাড়া কি হারে বাড়ে বা কিভাবে বাড়া উচিত অথবা আদৌই বাড়া উচিত কিনা এ নিয়ে সরকারী কোন নীতিমালা আছে কিনা আমি জানি না। থাকতেও পারে (কি নেই এই দেশে!) কিন্তু তার কোন বাস্তবায়ন আছে বলে আমার জানা নেই; অন্তত আমার এই ভাড়াটে জীবনে তার কোন প্রয়োগ দেখি নাই। সেই ২০০৭ সাল থেকে ২০১৭ সালের বিভিন্ন সময়ে অফিসিয়াল কাজ থেকে শুরু করে দাওয়াত খাওয়াসহ বিভিন্ন উছিলায় শ্রমিকদের ঘরগুলিতে যাওয়া হয়েছে। আর তাই শ্রমিকেরা কোথায় থাকে তা আমি শ্রমিকদের ঘরগুলিতে গিয়ে দেখেছি। বাসাভাড়া বিষয়টি তখন থেকেই দারুণ ভাবে জানি। সেসব ঘরের মালিকেরা তিনটি কারণে ঘরের ভাড়া বাড়িয়ে থাকেন। সেগুলি হলো ‘এ কারণ’, ‘সে কারণ’ ও ‘নানাবিধ কারণ’। বার্ষিক বেতন বেড়েছে অতএব বাসাভাড়া বাড়াও, এলাকায় নতুন ফ্যাক্টরী হয়েছে অতএব বাসা ভাড়া বাড়াও। ২০১৩ তে নতুন মজুরী কাঠামো হয়েছিলো, বাসা ভাড়া বেড়েছিলো। অতএব ২০১৯ সালেও কাঠামো এর অনুপাতে বাসাভাড়া বাড়বে। তাই নতুন কাঠামোতে শ্রমিকদের চেয়ে বাসার মালিকেরা লাভবান হবেন বেশী। সরকার যদি এদিকে কোন পদক্ষেপ না নেন, তাহলে কি আর করা!
এর পরের বিষয়টি নিয়ে আমি একটু বিভ্রান্ত। সেটা হচ্ছে কারখানার সক্ষমতা ইংরেজীতে যাকে বলে Industry Capability. আমি অন্তত ১০০ গার্মেন্ট ফ্যাক্টরীর সাথে কোন না কোনভাবে কাজ করেছি। সেখানে সক্ষমতার পার্থক্য বিস্তর। জানি না এই সক্ষমতাকে মজুরীবোর্ড কিভাবে দেখবেন। সেখানে এক্সপার্ট লোকেরা থাকবেন, তারা নিশ্চয় একটা সাধারণ মাপকাঠিতে নিয়ে আসবেন। আমার বিভ্রান্তীর বিষয় হচ্ছে ২০১৩ এর ওয়েজ বোর্ডে যেভাবে গ্রেডিং করা হয়েছিলো তার সাথে শ্রমিকের দক্ষতার সমন্বয়ের কোন নির্দিষ্ট রূপরেখা ছিল না। এবারো যদি তাই হয় তবে ফাক্টরী গুলির জন্য কিঞ্চিৎ অশনীসংকেত দেখা দেয়ার ক্ষীণ সম্ভাবনা আছে। বিষয়টি একটু খোলসা করে বলার চেষ্টা করি।
গার্মেন্ট ফ্যাক্টরী গুলির মধ্যে খুব কম প্রতিষ্ঠানে শ্রমিকের দক্ষতা উন্নয়নের জন্য পদক্ষেপ নেয়। আমি টেকনিক্যাল দিকের কথা বলছি। এখন একজন শ্রমিকের পেছনে মাথাপিছু খরচের বিপরীতে কত টাকা আয় হচ্ছে সেটা নির্ণয় করাটা খুব জরুরী হয়ে পড়বে। আমাদের ইন্ডাষ্ট্রিয়াল ইঞ্জিনিয়ার ও মালিকেরা ‘হেল্পার ছাড়া লাইন’ ভালো নাকি ‘হেল্পার সহ লাইন’ ভালো এই চক্করে অনেকদিন ধরেই ঘুরছেন। নতুন কাঠামোতে মজুরী কত বাড়বে জানি না। তবে যাই-ই বাড়ুক প্রসেসের স্টান্ডার্ড মিনিট কস্ট এনালিসিস খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়াবে এটা নিশ্চিত। সেখানে কোন গ্রেডের শ্রমিকের দক্ষতার লেভেল কি হওয়া উচিত এই সমন্বয় করাটা মানবসম্পদ বিভাগের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। ধরুন ওভারলক মেশিনের একজন সাইড সীম অপারেটর যে শুধু ওভারলক মেশিনেই সাইড সীম প্রসেসই পারে এবং ঘন্টায় টার্গেট অর্জন করতে পারে, তাকে আপনি ৭০০০ টাকা দিয়ে নিচ্ছেন। আবার আরেকজন একই সাথে ওভালকমেশিনে সাইডসীম সহ ফিড অফ দ্য আর্ম মেশিনেও সাইড সীম করতে পারে টার্গেট অনুসারে, তাকে আপনি কত টাকা দিয়ে নিবেন? সে নিশ্চয় বর্তমান বাজারে ৭০০০ টাকায় কাজ করবে না? এদিকে ক্যাচাল যদি আবার বাধে যে তার ক্যাপাসিটি ঘন্টায় ১০০ পিছ কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, আপনার ফ্যাক্টরীতে তার লাইনে ঘন্টায় হয় ৭০ পিছ।
শার্ট ফ্যাক্টরীতে দেখা যায় অনেক শ্রমিক কেবল ফ্রন্ট লোয়ার পার্ট রোলিং করছে বছরের পর বছর। বর্তমান কাঠামোতে যার মজুরী হয়তো ৬৫০০ টাকা। মাস শেষে মূলবেতন, ওভারটাইম, এটেন্ডেন্স বোনাস সব সহ ৯০০০ টাকা পাচ্ছে। নতুন কাঠামোতে তার বেতন বাড়বে, বছর গেলে বেসিকের ৫% করে বাড়বে। হিসাব করে দেখুন আগামী ৩ বছরে তার বেতন কত হবে? আপনার ইন্ডাষ্ট্রিয়াল ইঞ্জিনিয়ারকে হিসাব করতে বলুন যে ঐ কাজের এসএমভি অনুযায়ী সিএম কত আসে। এবার ঠান্ডা মাথায় যাবতীয় খরচ যোগ করে ঐ প্রসেসের আয়ব্যয় দেখুন। হিসাবটা জটিল হলেও, এর উপর ভিত্তি করে যে সিদ্ধান্ত নিবেন সেটা মজার। এখন আপনি কি আজীবন ঐ শ্রমিককে ফ্রন্ট লোয়ার পার্ট রোলিং-এর কাজে রাখবেন? নাকি প্রশিক্ষণ দিয়ে অন্য কাজ শেখাবেন যাতে তার বার্ষিক ৫% বেতন বৃদ্ধির তার দক্ষতা অন্তত একই হারে বাড়তে থাকে?
এখন আসুন একটা সর্বোপরী হিসাব করি। শ্রমিকের মজুরী আসলে এক্সপোর্ট ভ্যালুর কত পার্সেন্ট? আপনার যাবতীয় খরচের খাত গুলি একটা সাদা কাগজে লিখে প্যারেটো রুল এপ্লাই করে দেখুন তো, কোন ২০% খাত আপনার খরচের ৮০% এর দখল করে আছে। খুব ভালো করে দেখুন। সিদ্ধান্ত নিন কোন কোন খাতে উন্নয়ন করলে এই নতুন কাঠামো আপনার জন্য কোন বিষয়ই না? আশা করি উত্তর পেয়ে গেছেন। কি মনেহয়? দারুণ না খাত গুলি?
আর যদি এখনো ধরতে না পারেন, তাহলে কনসাল্টেন্ট হিসাবে আমরা তো আছিই। ১০০% খাটি দেশী কনসাল্টেন্ট!
হ্যাপী গার্মেন্টিং!
Leave a Reply