
আব্দুল আলীম
(লেখক এই লেখাটি ২০১৬ ইং সালে একটি বাস্তব ঘটনার প্রেক্ষিতে লিখেছেন )
গত ১৭ জুন রাত আনুমানিক ১১.৩০ মিনিটে খন্দকার নাজমুল ইসলাম নামের এক ভদ্রলোকের সাথে হাটছিলাম। হঠাৎ একটি ফোন কল আসার পর উনি অত্যন্ত বিনয়ী সুরে শুধু “স্যার স্যার” উচ্চারণ করছিলেন। বোঝা যাচ্ছিল কাউকে ম্যানেজ করার প্রাণান্ত চেষ্টা করছেন। ফোন রেখেই আরেকটি ফোন কল করে আরেকজনকে নির্দেশনা দিচ্ছিলেন। বুঝতে আর বাকি রইল না যে, তিনি তাঁর কোন অধিনস্তের সাথে কথা বলছিলেন। তিনি হলেন আমাদের অর্থনীতির চালিকাশক্তি পোশাক খাতের কোন এক কারখানার বড় মাপের একজন কর্মকর্তা। ঠিক নাজমুল সাহেবের মত পোশাক শিল্প প্রতিষ্ঠানে কর্মরত প্রায় ২/৩ লক্ষ কর্মকর্তা কর্মচারীবৃন্দ এভাবেই দিনরাত তাদের মেধা, শ্রম আর সময় দিয়ে আমাদের পোশাক খাতকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন, কিন্তু তাদের সে অবদানের নেই কোন স্বীকৃতি! এমনকি কেউ কখনো জানতেও চান না, কেমন আছেন তারা!
শ্রমিকের কথা বলতে আছে শ্রমিক সংগঠন (যদিও অধিকাংশ শ্রমিক সংগঠন শ্রমিকের স্বার্থে কাজ না করে নিজেদের স্বার্থে কাজ করেন বলে অভিযোগ আছে), ঠিক তেমনি মালিকের স্বার্থ রক্ষার জন্য রয়েছে মালিকদের সংগঠন । কিন্তু শীল-পাটার মাঝামাঝি অবস্থান করা এই কর্মকর্তাদের স্বার্থে কথা বলার মত কেউ নেই। তাদের কপালে রয়েছে শুধুই লাঞ্ছনা! মালিক শ্রমিকের অধিকার হরণের অন্যায় আদেশ দেন , এমতাবস্থায় বিবেকের সাথে আপোষ করে, চাকুরী রক্ষার তাড়নায় কখনও কখনও তাঁর কলমের লেখনীতেই শ্রমিক তার প্রাপ্য অধিকার হারান । আর সে কারনে কারখানায় সৃষ্টি হয় শ্রমিক অসন্তোষ। মালিক বলে তুমি অযোগ্য তাই সামলাতে পার না, অপরদিকে শ্রমিক বলে মালিক ভাল কিন্তু ঐ ম্যানেজার আমাদের অধিকার কেড়ে নিয়েছে। মালিক শ্রমিক সমঝোতা হলেও ব্যর্থতার দায়ভার নিতে হয় সেই ম্যানেজারকেই!
শ্রমিকদের সময়মত বেতন দেয়ার জন্য মালিকরা প্রাণপণ চেষ্টা করেন। সাধারণত কোন মালিক ইচ্ছে করে শ্রমিকের বেতন দিতে দেড়ী করে কারখানার সুনাম নষ্ট করতে চান না। চান না অযথা ঝামেলায় জড়াতেও। তবে আমাদের পোশাক খাতের অধিকাংশ কারখানার কর্মকর্তারা সময়মত তাদের বেতন পান না। যেহেতু মালিকের সমস্যার কোন শেষ নেই তাই প্রতি মাসেই তাদেরকে শুনতে হয়, “আগে শ্রমিকদের বেতনটা দিয়ে নেই তারপর আপনাদের কথা ভাবছি” এমনি করে অনেক সময় তাদের কয়েক মাসের বেতন বকেয়া থেকে যায় , আর চাকরি থেকে ইস্তফা দিলে সেই টাকা কপালে জোটে এমন নজীরও কম।
শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষার্থে আছে শ্রম আইন। আইএলও সহ নানা দেশী ও বিদেশী আইনে সাধারণ কর্মদিবস হয় ৮ ঘন্টায়। আর আট ঘন্টার এর চেয়ে বেশী সময় কাজ করলে তারা অধিক কাল কাজ করার জন্য পাবেন অতিরিক্ত ভাতা। ছুটির দিনে কাজ করলেও পাবেন অতিরিক্ত ভাতা। তবে খন্দকার নাজমুল সাহেবদের মত কর্মকর্তারা কারখানায় ১২ ঘন্টা কাজ করার পরেও বাড়ী ফেরার পথে মালিকের ফোন আর ফোনের নির্দেশনা অনুযায়ী তার অধিনস্তদের দিক নির্দেশনা প্রদানপূর্বক পরিচালনা করার চেষ্টা করছেন । এমনকি কখনো হয়ত ঘুমের মধ্যে হঠাৎ ফোন কল আসায় কিংবা জরুরী ইমেইল আসায় স্মার্ট ফোনটি বেজে ওঠে একটি দুঃসংবাদ দেয়ার জন্য, ইন্সপেকশন ফেল করেছে! মালিকের মাথা গরম। হয়তো কারো উইকেট পড়ে যাবে (চাকরি চলে যাবে)। পরের দিন শুক্রবার, মিসেস কে নিয়ে ডাক্তার এর কাছে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কিসের ডাক্তার; কিসের কি? চাকুরী ঠেকানোই যে দ্বায় ! অধিক রাত অবধি কাজ করে হোক আর কারখানায় রাত্রিযাপন করেই হোক সকল ঝামেলা মিটিয়েই বাড়ি ফিরতে হবে। ঝামেলা মেটাতে ইন্সপেক্টর কে স্যার স্যার বলে মুখে থুতু এসে যায় কিন্তু বিধি বাম, আবার ইন্সপেকশন ফেল। অতিরিক্ত কাজের পারিশ্রমিক দূরে থাক, ছুটির দিনে কাজ করার জন্য ধন্যবাদ দূরে থাক, পরদিন সকালে গিয়ে শুনতে হয় কোয়ালিটি ম্যানেজার সহ কয়েকজনের চাকুরী নাই! এটা কোন বানানো গল্প নয় এটাই বাস্তবতা! কোন প্রতিবাদ না করে পরদিন শুভাকাঙ্খিদের কাছে একটা চাকুরীর আবেদন করা আর চোখ মুখে শুধুই অন্ধকার!
হঠাৎ এক সকালে একটি ফোন কল পেলাম, কোন এক কমপ্লায়েন্স কারখানায় কাজ চলাকালীন শ্রমিকদের মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে দেয়ার দাবীতে আন্দোলন। এরপর এক দাবী গিয়ে ঠেকলো কয়েক দফা দাবীতে। মালিক অধিকাংশ দাবী মেনে নিয়ে শান্ত করলেন শ্রমিকদের। দুদিন পরে একজন ফোনে জানালেন সেই কারখানার কমপ্লায়েন্স ম্যানেজারের চাকুরী নেই। অতঃপর আমি সেই কমপ্লায়েন্স ম্যানেজারের কাছে ফোন করে কারণ জানতে চাইলাম কিন্তু তিনি অভিযোগ করতেও সাহস পেলেন না। অথচ তার মাথায় পুরো কারখানার শ্রমিক অধিকার রক্ষার দায়িত্ব ছিল। এই তিনিই এতদিন অডিটর এর চোখ ফাঁকি দিয়ে কারখানাকে অডিটে পাস করাতে ব্যতিব্যস্ত ছিলেন, হয়তো কখনো নতুন বায়ার কারখানা ভিজিট করবে জেনে তিনিই দিনরাত শ্রম দিয়ে কারখানাকে বউ সাজ সাজিয়ে বায়ারকে সন্তুষ্ট করতে সচেষ্ট ছিলেন ।
কারখানার এইচআর ম্যানেজার, যিনি স্বাক্ষর করে সকল শ্রমিকের নিয়োগ দেন সেই তিনিই আবার কখনো মালিকের আদেশে কাউকে চাকুরী থেকে বরখাস্ত করে মালিকের কাছে গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেন। আর বরখাস্তকৃত শ্রমিক শ্রম আদালতে গিয়ে মামলা ঠুকে দেন এইচআর ম্যানেজারের নামে। মামলার হাজিরা শেষ হবার আগেই চোখের নিমেষে সেই এইচআর ম্যানেজারই চাকুরী হারিয়ে ফেলেন, কোথায় গেল সেই গ্রহণযোগ্যতা! আর কোন প্রকার মামলা কিংবা অভিযোগ না করে মাথা নিচু করে বের হয়ে এসে চোখে মুখে অন্ধকার নিয়ে খুঁজে ফেরেন আরেকটি চাকুরী।
আজকের অ্যাকর্ড/এলায়েন্স/বিএসসিআই সহ বায়ারদের নানা চাহিদা পুরণ করতে পাগল প্রায় অবস্থা এই অ্যাডমিন/এইচআর/ কমপ্লায়েন্স ডিপার্টমেন্ট এ চাকুরীরত কর্মকর্তাদের। সব সময় মালিকপক্ষ যথেষ্ট সাপোর্ট না দিলেও অডিট পাস করা চাই, যেন হাতের মোয়া! আর অডিট পাস করলে বিন্দু মাত্র ধন্যবাদ না জূটলেও অডিট ফেল করার পরের দিন চাকুরী চলে যাবার ঘটনা শত শত। কখনও কখনও আবার অডিট পাস করেও চাকুরী থাকেনা কারন অডিট পাস করার পরে মালিকের কাছে তার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে। যারা শ্রমিক অধিকারের মন্ত্র আওরান সব সময়, যারা নানা কৌশল করে অডিট পাসের আপ্রাণ চেষ্টা করে যান সেই সমস্ত নিবেদিতপ্রাণ লোকদেরই চাকুরীর ক্ষেত্রে নেই কোন নিরাপত্তা! নেই কোন ওভার টাইম ভাতা বা অন্যান্য সুবিধা। তাদের জন্য বড্ড দুঃখ হয় কারণ তারা চাইলেই বস্তিতেও থাকতে পারেন না আবার ভাল বাসা ভাড়া নেয়ার সামর্থ্যও তাদের নেই, এমনকি তারা তাদের কষ্টের কথাটিও মুখ ফুটে বলতে পারেন না। পরিশেষে একটা আফসোস থেকেই যায়, এই নিবেদিতপ্রাণ কর্মকর্তা কর্মচারীদের দুঃখ ঘোচানো দূরে থাক তাদের দুঃখ অনুধাবন করার মতও কেউ নেই!
লেখক : সম্পাদক, দি আরএমজি টাইমস
Leave a Reply